যমুনা কিনারে

ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে

ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে।
মধুকরনিকরকরম্বিতকোকিলকূজিতকুঞ্জকুটীরে।।
বিহরতি হরিবিহ সরসবসন্তে।
নৃত্যতি যুবতিজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে।।ধ্রু।।
উন্মদমদনমনোরথপথিকবধূজনজনিতবিলাপে।
অলিকুলসঙ্কুলকুসুমসমূহনিরাকুলবকুলকলাপে।।
মৃগমদসৌরভরভসবশংবদনবদলমালতমালে।
যুবজনহৃদয়বিদারণমনসিজনখরুচিকিংশুকজালে।।
মদনমহীপতিকনকদণ্ডরুচিকেশরকুসুমবিকাশে।
মিলিতশিলীমুখপাটলিপটলকৃতস্মরতূণবিলাসে।।
বিগলিতলজ্জিতজগদবলোকনতরুণকরুণকৃতহাসে।
বিরহিনিকৃন্তনকুন্তমুখাকৃতিকেতকিদন্তুরিতাশে।।
মাধবিকাপরিমলললিতে নবমালিকয়াতিসুগন্ধৌ।
মুনিমনসামপি মোহনকারিণী তরুণাকারণবন্ধৌ।।
স্ফুরদতিমুক্তলতাপরিরম্ভণপুলকিতমুকুলিতচূতে।
বৃন্দাবনবিপিনে পরিসরপরিগতযমুনাজলপূতে।।
শ্রীজয়দেবভণিতমিদমুদয়তি হরিচরণস্মৃতিসারম্।
সরসবসন্তসময়বনবর্ণনমনুগতমদনবিকারম্।।

অন্তঃকথন:
আমার প্রেমময়ী শ্রীরাধিকা। মানময়ী শ্রীরাধিকা। প্রিয়মিলনের জন্য যখন পাগলপারা হয়ে বসে আছেন তিনি, তখন তাঁর সখীরা কৃষ্ণের অবস্থান জেনে এসে তাঁকে এমন ভাবেই সংবাদ দিচ্ছেন যাতে তাঁর ঈর্ষা-মান আরও বেড়ে যাচ্ছে। সখীরা বলছেন - তোমার পরাণবঁধূ হরি এখন নৃত্যপরা ব্রজযুবতীদের সঙ্গে বৃন্দাবনের বনভূমিতে বিহার করে বেড়াচ্ছেন -নৃত্যতি যুবতিজনেন সমং সখি। আর এমন বিহারেচ্ছার কারণও তো আছে- বসন্ত এসে গেছে যে! ঋতুর সমস্ত সরসতা নিয়ে বসন্ত এসে গেছে। সেই সরস বসন্তে হরি এখানে বিহার করছেন- হরিরিহ সরস বসন্তে। এই যে বসন্তের কালা-আধারে একটা সপ্তমী বিভক্তি লাগল, 'সরসবসন্তে'- এরপর সখীরা যা বলবেন তা সবই এই বসন্তের বিশেষণ হিসেবে কাজ করবে। সখীরা রাধাকে বলছেন - কেমন এই বসন্তে তোমার পরাণ সখা কাদের সঙ্গে কেমন অবস্থায় বিহার করছেন শোনো। যে বসন্তের মৃদু মন্দ মলয় বাতাস পুষ্পময়ী লবঙ্গলতার আলিঙ্গন- বাধায় আরো মন্দ মধুর হয়ে উঠেছে, সেই বসন্তে বিহার করছেন কৃষ্ণ। যে বসন্তে অলিগুঞ্জনে আর কোকিল্কূজনে কুঞ্জকুটীর মুখরিত, সেই বসন্তে বিহার করছেন শ্রীহরি। আহা এই দুরন্ত বসন্তে (তোমার মত) বিরহীদের বেদনাাজ্বালা কি প্রবল হয়ে ওঠে, আর এই বসন্তেই বনমালী ব্রজবধূদের সঙ্গে নৃত্য বিহার করছেন! দেখতো সখী এই বসন্ত কেমন দুমুখো, একদিকে বিরহিনী পথিকবধূরা প্রবাসী প্রিয়ের জন্য বিলাপ করছে আর অন্যদিকে কুসুমিত বকুল শাখায় দলে দলে ভ্রমর এসে জুটেছে। বকুলতরু অবধি ভ্রমরদের জ্বালায় ব্যাকূল হয়ে উঠেছে আর মানুষের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এমন বসন্তেই তোমাকে একা ফেলে মাধব অন্যদের নিয়ে বিলাসবিহারে মেতে উঠেছেন। এই বসন্তে মদন প্রকৃতিতে তাঁর মায়াজাল বিছিয়ে রেখেছেন, নবমুকুলিত তমালফুলের গন্ধ যেন কস্তুরী গন্ধের মত মনকে অবশ করে ফেলছে ! আর সেই অবশ মনকে বিদ্ধ করার সবকটি অস্ত্র অনঙ্গ পুষ্পে পুষ্পে সাজিয়ে রেখেছেন। পলাশফুল্গুলিকে মনে হচ্ছে কামদেবের তীক্ষ নখর, এক্ষুনি হৃদইয়ে প্রেমের আঁচর বসিয়ে দেবে।দেখো সখী, ভ্রমর বেষ্টিত পাটলি পুষ্পগুলিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন অনঙ্গের শরপূর্ণ তূনীর আর কেশর পুষ্প গুলি তো তাঁর সুবর্ণ দণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বসন্তে কার ওপর কখন যে অনঙ্গের প্রেমদন্ডাজ্ঞা নেমে আসবে কিছুই বলা যায় না। তা এই বসন্তে শ্রীহরি প্রেম বিহার না করে আর কীই বা করবেন বল! আবার দেখো জগতের এই লজ্জাহীন করুণ দশা দেখে শুভ্র বাতাবী আর কেতকী কুসুম গুলি কেমন দন্ত বিকসিত করে হাসছে। আহা মালতীগন্ধে সুরভিত এই বসন্ত মুনিজনেরও মন টলিয়ে দেয় আর যুব হৃদয়ের তো সে পরম বন্ধু। দেখো সখী, যমুনাতীরে বৃন্দাবন বিপিনে, এই দুর্বার বসন্তে সহকার তরু অবধি কল্পিত মালতীলতার আলিঙ্গন কল্পনা করে পুলকে মুকুলিত হয়ে উঠেছে। শ্রীহরিও অনঙ্গের জালে ধরা পড়েছেন। তাই এই মায়া ময় বসন্তে মাধব ব্রজবধূদের সঙ্গে প্রেমভরে নৃত্য বিহার করছেন। আহা! এইভাবেই সখীরা, প্রেমময় বসন্তের বর্ননা করে শ্রীমতীর মনে মদনাগুনকে দ্বিগুন করে তুলেছেন। আবার অন্যদিকে এই বসন্তে রাধিকাকে একেলা রেখে বনমালী ব্রজাঙ্গনাদের সঙ্গে প্রেমবিহারে করছেন এই কথা বলে বলে সখীরা শ্রীমতীর মানকে দুর্জয় করে তুলেছেন। গীতগোবিন্দের রাধা কৃষ্ণের মান অভিমান ময় দিব্য প্রেমলীলা এই প্রথম স্বর্গ 'সামোদ-দামোদর'এই সুচিত হয়ে গেল। আর এইগান জয়দেব কেন রচনা করেছেন? তিনি চান কৃষ্ণের এই বিলাস লীলা শ্রবণ করে ভক্তমনে জগতের সার শ্রীহরির পাদপদ্মের স্মৃতি জাগরিত হয়ে উঠুক। আর কিছু নয়। বনমালীর প্রেমলীলা স্মরণ করাও তো আসলে তাঁকেই স্মরণ করা!

পদকর্তা:জয়দেব
রাগ:বসন্ত
তাল:যতি
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী