যমুনা কিনারে

আএল ঋতুপতি রাজ বসন্ত

আএল ঋতুপতি রাজ বসন্ত।
ধাওল অলিকুল মাধবি পন্থ।।
দিনকর কিরণ ভেল পৌগণ্ড।
কেসর কুসুম ধএল হেমদণ্ড।।
নৃপ আসন নব পীঠল পাত।
কাঞ্চন কুসুম ছত্র ধরু মাথ।।
মৌলি রসাল মুকুল ভেল তায়।
সমুখ হি কোকিল পঞ্চম গায়।।
সিখিকুল নাচত অলিকুল জন্ত্র।
দ্বিজকুল আন পঢ় আসিখ মন্ত্র।।
চন্দ্রাতপ উড়ে কুসুম পরাগ।
মলয়পবন সহ ভেল অনুরাগ।।
কুন্দবল্লী তরু ধএল নিসান।
পাটল তূন অসোক দল বান।।
কিংসুক লবঙ্গলতা এক সঙ্গ।
হেরি সিসির রিতু আগে দল ভঙ্গ।।
সৈন সাজল মধুমখিকা কুল।
সিসিরক সবহু কএল নিরমূল।।
উধারল সরসিজ পাওল প্রান।
নিজ নব দলে করু আসন দান।।
নব বৃন্দাবন রাজ বিহার।
বিদ্যাপতি কহ সময়ক সার।।

অন্তঃকথন:
রাধামাধবের প্রণয়ের উদ্দীপন বিভাব বৃন্দাবনের প্রকৃতি। পদাবলীর কবিরা তাই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বর্ণনার পাশাপাশি বৃন্দাবনের বর্ষা-শরৎ-বসন্তের প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন সমান দক্ষতায়। জয়দেব যেমন বসন্ত রাসে মাদক বসন্তপ্রকৃতির সুনিপুণ চিত্র এঁকেছেন, তাঁরই ছায়া অনুসরণ করে যেন এই পদে বসন্তবর্ণনা করেছেন। কবি বলছেন, ঋতুপতি রাজা বসন্ত এলেন। তাঁর আগমনবার্তা নিয়ে অলিকুল দিকে দিকে ছুটে চলল, প্রথমেই তারা গেল বসন্তের প্রিয়তমা মাধবীর কাছে। সূর্যের কিরণ শৈশব অতিক্রম করে পৌগণ্ড দশা প্রাপ্ত হল। কেশরকুসুম হেমদণ্ড ধরল ঋতুরাজের জন্য। নতুন পিঠালী পাতায় রাজার আসন পাতা হল। কাঞ্চন ফুল রাজার মাথায় ছত্র ধারণ করল। আম্রমুকুল তাঁর শিরোভূষণ হল। ঋতুরাজের মনোরঞ্জনের জন্য কোকিল পঞ্চমতানে গান ধরেছে আর শিখীকুল রাজসভার নর্তকীর মত নৃত্য শুরু করল। অন্য দ্বিজগণ অর্থাৎ পক্ষীকুল রাজ উদ্দেশ্যে আশিষ মন্ত্র পাঠ করছে। সকল কুসুমের পরাগ উড়ে চন্দ্রাতপের আকার ধারণ করল। মলয় পবন কুসুম পরাগকে প্রবাহিত করল যেন কুসুম পরাগের সঙ্গে তার অনুরাগ জন্মালো। বৃক্ষগণ কুন্দলতায় রাজনিশান উড়িয়ে দিল। পাটলি ফুল যেন রাজার তুণ আর অশোকফুলগুলিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন রাজার বাণসমূহ! কিংশুক এবং লবঙ্গলতাকে একসঙ্গে প্রণয়াবদ্ধ দেখে শিশির ঋতু আগেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। যেটুকু শিশিররেখা বাকি ছিল মধুমক্ষিকারা যেন রাজসৈন্যের মত সেটুকুও নির্মূল করল! শিশিরমুক্ত হয়ে কমল যেন উদ্ধারমুক্ত হয়ে নূতন প্রাণ পেল! প্রাণ ফিরে পেয়ে পদ্ম নিজের পাপড়িকে আসন দান করল। নব বৃন্দাবন রাজের বিহার আজ! আজি বসন্ত এল! বিদ্যাপতি বলছেন এই বসন্তই সকল সময়ের সার! এই পদটির সঙ্গে জয়দেব বিরচিত “ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে।" পদটির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে বিদ্যাপতির পদ সামগ্রিকতায় অনেকাংশেই আলাদা। বিদ্যাপতি যে অগ্রজ কবিশ্রেষ্ঠ জয়দেবের দ্বারা অনুপ্রাণিত এতে আশ্চর্যের কিছু নেই! জয়দেবের থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেও তিনি যে নিজস্বতা দেখাতে পেরেছেন সেখানেই তাঁর কৃতিত্ব।

পদকর্তা:বিদ্যাপতি
রাগ:অজ্ঞাত
তাল:অজ্ঞাত
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী