বৈষ্ণব পদাবলী কেবল বৈষ্ণবের গান নয়। চিরন্তন মানব–মানবীর দুকূল প্লাবিত হৃদয়ের অন্তরঙ্গ কথা। তাইতো এর কথায়, সুরে মধুররসের সংবেদনশীল তারে সপ্তসুরের যে অপরূপ লহরী ওঠে তারই মূর্চ্ছনা শোনা যায় বৈষ্ণবের পদে। কিন্তু প্রণয় তো একরঙা নয়, সে নিতুই রঙিন থেকে রঙিনতর, মধুর থেকে মধুরতর, গভীর থেকে আরও গভীরের দিকে পথ চলে। এজন্যই তো বৈষ্ণব রসজ্ঞগণ পথপ্রদর্শকের দায়িত্বটি পালন করেছেন প্রেমের স্তরগুলির স্বরূপ বোঝানোর উদ্দেশ্যে।
প্রেমের প্রথম উন্মেষ
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ হল ‘উজ্জ্বলনীলমণি’। সেখানে বৈষ্ণব রসজ্ঞ তথা পণ্ডিত ব্যক্তি শ্রীরূপ গোস্বামী শৃঙ্গার বা মধুর রসের দুটি ভাগের কথা বলেছেন। যার প্রথমটি হল বিপ্রলম্ভ, যাকে আমরা বলতে পারি বিচ্ছেদ বা বিরহ। ‘স বিপ্রলম্ভঃ সম্ভোগ ইতি দ্বেধোজ্জ্বলো মতঃ’। বিপ্রলম্ভই সম্ভোগের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে। পূর্বে মিলিত বা মিলন হয়নি এমন, পরষ্পর অনুরক্ত নায়ক-নায়িকার চুম্বন আলিঙ্গনাদির অপ্রাপ্তির ফলে যে ভাব, তাই হল বিপ্রলম্ভ। তিনি আরও বলেছেন, ‘ন বিনা বিপ্রলম্ভেন সম্ভোগঃ পুষ্টিমশ্নুতে’। অর্থাৎ কিনা বিপ্রলম্ভ ছাড়া সম্ভোগের পুষ্টি বিধান হয় না। মধুর রসের দ্বিতীয় ভাগটি হল সম্ভোগ। বিপ্রলম্ভ সম্ভোগের উন্নতিকারক – ‘স বিপ্রলম্ভ বিজ্ঞেয়ঃ সম্ভোগোন্নতিকারকঃ’। বিরহের করণেই মিলন মধুময়। এই বিপ্রলম্ভ চতুর্ধাবিভক্ত –
পূর্বরাগস্তথা মানঃ প্রৈমবৈচিত্ত্যমিত্যপি।
প্রবাসশ্চেতি কথিতো বিপ্রলম্ভশ্চতুর্বিধঃ।।
পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য ও প্রবাস – এই চার রূপের কথা বলা হয়েছে ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে।
প্রথমে পূর্বরাগের কথা। প্রিয় বা প্রিয়তমার প্রতি প্রণয়ের প্রথম উন্মেষকে আমরা পূর্বরাগ বলে জানি। ঊষাকালে সূর্যাতপের জাগরণের সাথে সাথে মুদিত পদ্মকোরকের অন্তরে জেগে ওঠার, নিজেকে মেলে ধরার যে প্রথম উদ্দীপন দেখা যায়, তাই তো পূর্বরাগ। প্রণয়রাগে রঞ্জিত হবার পূর্ব অবস্থা। মিলন হয় নি, অথচ নায়ক-নায়িকা উভয়ে দেখেছেন উভয়কে, মুগ্ধ হয়েছেন পরস্পরের গুণাবলী শ্রবণে, অন্তরে উৎপন্ন হয়েছে অনুরাগ, অঙ্কুরিত হয়েছে মিলনের আকাঙ্ক্ষা – প্রণয়ের এই অবস্থাই পূর্বরাগ।
‘সাহিত্যদর্পণ’কার বিশ্বনাথ কবিরাজ পূর্বরাগের লক্ষণ নির্দেশ করে বলেছেন –
শ্রবণাদ্দর্শনাদ্বাপি মিথঃ সংরূঢ়রাগয়োঃ
দশাবিশেষো যো’প্রাপ্তৌ পূর্বরাগঃ উচ্যতে।।
অর্থাৎ দর্শন ও শ্রবণের ফলে নায়ক-নায়িকার পারষ্পরিক অপ্রাপ্তিজনিত দশা বিশেষ হল পূর্বরাগ। সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে কুমারসম্ভবে পার্বতীর, নলোদয় কাব্যে নলের গুণকথা শ্রবণে দময়ন্তীর মনে, আবার দুষ্মন্তকে দর্শন করে অভিজ্ঞানশকুন্তলা নাটকে শকুন্তলার মনে পূর্বরাগের সঞ্চার হতে দেখা যায়। তবে বৈষ্ণব পদকর্তার প্রণোদিত কবিস্বভাব আরও রমণীয়ভাবে পূর্বরাগ কীর্তন করেছে। সেই সঙ্গে মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরে বৈষ্ণব তত্ত্ব ও রসচিন্তার মধ্যে নিগূঢ় অথচ সূক্ষ্ম বৈদগ্ধ্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তার প্রতিফলনে পূর্বরাগের পদে যুক্ত হয়েছে অভিনব চারুত্বের রসায়ন, পদাবলী হয়েছে আরও উজ্জ্বল। বৈষ্ণবতত্ত্বের মহাগ্রন্থ ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে পূজ্যপাদ শ্রীরূপ গোস্বামীর কথায় শোনা যায় তারই অনুরণন –
রতির্যা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা ।
তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে ।।
অর্থাৎ যে রতি মিলনের পূর্বে রূপ দর্শন, রূপ গুণাদির কথা দ্বারা উৎপন্ন হয়ে নায়ক-নায়িকার হৃদয়কে উন্মীলিত করে, তারই নাম পূর্বরাগ। পূর্বরাগে যে রতির উদ্গম হয়, তাঁর ফলে জন্ম নেয় মিলনের বাসনা। কিন্তু তৃষ্ণা পরিপূরিত না হওয়ায় বিপ্রলম্ভের উদ্ভব। এ সময় প্রিয়ের অনন্যমনা চিন্তার ফলে ঘটে রসস্ফূর্তি। পরিণতিতে পূর্বরাগ রতি রসতাপ্রাপ্ত হয়। ‘রসকম্পবল্লী’তে এ সম্পর্কে বলেছে, ‘সঙ্গ নহে রাগ জন্মে কহি পূর্বরাগ’। অর্থাৎ সঙ্গ বা মিলন নয় হৃদকমলে প্রথম প্রেমের উন্মেষ। খানিকটা এ যুগের ভাষায়, Love at first sight। অবশ্য এ সংকীর্ন অর্থে। পূর্বরাগে ভাগবত নিবিড়তার বিস্তার আর গভীরতা অনেক বেশী। মানব মনে সঞ্চারিত অনুভূতি সমর্পিত হয়েছে দেবতার উদ্দেশ্যে। এক দেহে লীন হয়েছে প্রিয় ও দেবতা। তাইতো, ‘দেবতাকে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’। মনে রাখতে হবে যাঁকে নিয়ে কথা বলছি তিনি বিরাট বিজ্ঞানময় পুরুষ, এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর থেকেই জাত, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ রূপে তাঁর সকল শক্তির মূলাধাররূপী হ্লাদিনীশক্তি মহাভাবরূপিণী শ্রীরাধিকার সঙ্গে লীলা রচনা করেছেন।
পূর্বরাগের লক্ষণ
শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার মধ্যে মাধবের পূর্বরাগই প্রথমে সমুৎপন্ন হয়। কিন্তু শ্রীময়ীর পূর্বরাগেই চারুতার আধিক্য। রাধার পূর্বরাগের কথাই অধিক কথিত হয়ে থাকে। পূর্বরাগ রতির উন্মীলন হয় দুভাবে – ১) দর্শন ও ২) শ্রবণ। দর্শন চার প্রকার – সাক্ষাৎ দর্শন, চিত্রে দর্শন, স্বপ্নে দর্শন ও ইন্দ্রজালে দর্শন। দু –একটি নমুনা শোনানো যেতে পারে।
হাম সে অবলা হৃদয়া অখলা
ভালমন্দ নাহি জানি ।
বিরলে বসিয়া পটেতে লিখিয়া
বিশাখা দেখাল আনি ।।
চণ্ডীদাসের এই পদে চিত্রে দর্শনের মধ্য দিয়ে পূর্বরাগ রতির উন্মীলন ঘটেছে। অনুরূপ স্বপ্নে দর্শনের পদ রয়েছে –
মনের মরম কথা তোমারে কহিয়া এথা
শুন শুন পরাণের সই ।
স্বপনে দেখিলু যে শ্যামল বরণ দে,
তাহা বিনু আর কারো নই ।।
শ্রবণও চার প্রকারের। বন্দনা বা স্তুতি পাঠকের মুখে, দূতীর মুখে, সখীর মুখে ও গীত শ্রবণে। বংশীর সুরলহরী শ্রবণেও পূর্বরাগের উন্মেষ ঘটে। মনে পড়ে চণ্ডীদাসের বিখ্যাত পদ –
সই , কেবা শুনাইল শ্যাম নাম ।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ।।
এখানে কৃষ্ণের নাম শুনেই শ্রীরাধার মন প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছে। অবশ্য পদকর্তারা এই সকল লক্ষণ অনুসরণ করেছেন ঠিকই, তবে নিজ নিজ প্রতিভা রুচি অনুসারে বিষয় বর্ণনায় দিয়েছেন স্বাধীনতার পরিচয়। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’তে প্রথমে দর্শন এবং দর্শনের মধ্যে ক্রমান্বয়ে সাক্ষাৎ দর্শন, চিত্রে দর্শন, স্বপ্নাদিতে দর্শনের কথা বলা হলেও এই ক্রম পদকর্তারা অনুসরণ করেননি। এমনকি স্বয়ং রূপ গোস্বামী তাঁর ‘বিদগ্ধ মাধব’ নাটকে প্রথমেই লোকমুখে শ্যাম নাম শ্রবণ – ‘একস্য শ্রুতমেব লুম্পতি মতিং কৃষ্ণেতি নামাক্ষরং’, তারপর বংশীধ্বনি শ্রবণ, তারও পরে চিত্রে রূপ দর্শন বর্ণনা করেছেন। পৌর্বাপর্য রক্ষিত হয়নি। অনুরূপ লক্ষ্য করা যায় পদকর্তাদের ক্ষেত্রেও।
পূর্বরাগের নানা রূপ ও স্তর
কৃষ্ণ স্বয়ং সেই পরম পুরুষ। সকল রূপের, গুণের আধার। তাই এই লীলায় তাঁর প্রিয়াগণও সেইরূপ সৌন্দর্যময়ী ও গুণসম্পন্না। কৃষ্ণবল্লভাদেরই বলা হয় নায়িকা। এই নায়িকা দুই প্রকার – স্বকীয়া ও পরকীয়া। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে তিন প্রকার ভেদ – মুগ্ধা, মধ্যা, প্রগলভা। এদের পূর্বরাগের ধরণও ভিন্ন ভিন্ন। পূর্বরাগের আর এক বিশেষ অঙ্গ হল ‘অভিযোগ’। সাক্ষাৎ দর্শন হোক বা চিত্রপটে দেখা কিংবা স্বপ্ন দর্শনেই হোক না কেন, যাকে দেখেছি এবং দেখে ভালোবেসেছি, সখী, দূতী, ভাট বা গুরুজনের মুখে যার গুণকথা বা গুণগান শুনে মুগ্ধ হয়েছি, যার মধুর মুরলীধ্বনি আমাকে আত্মবিস্মৃত করেছে, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যে প্রচেষ্টা, তারই নাম অভিযোগ। নায়িকার মতো নায়কও অভিযোগে পটু। নায়ক-নায়িকার শ্রেণী ভেদ থাকলেও অভিযোগের প্রয়োগে সকলেই সমান। স্বভাবজ অভিযোগের নাম অনুভাব আর চেষ্টাকৃত অভিযোগকে বলে স্বাভিযোগ। মিলনের পরেও অভিযোগ অন্তর্হিত হয় না, তবে তখন থাকে অনুভাবের প্রাচুর্য। অভিযোগ তিন প্রকার – বাচিক, আঙ্গিক ও চাক্ষুষ। তবে পূর্বরাগে বাচিক অভিযোগের প্রয়োগ প্রায় থাকেই না। আঙ্গিকের ব্যবহার পূর্বরাগে দেখা যায়। কবিরা বলেছেন –
অঙ্গুলি স্ফোটন ছলে অঙ্গ সম্বরণ ।
চরণে পৃথিবী লেখে কর্ণ কণ্ডূয়ন ।।
নাসায় তিলক করে বেশ বিভূষণ ।
ভুরুর নর্ত্তন আর সখি আলিঙ্গন ।।
সখীর তাড়ন করে অধর দংশন ।
হারাদি গাঁথয়ে আর ভূষণের স্বন ।।
কৃষ্ণ আগে ভুজমূল প্রকাশিয়া রাখে ।
চিন্তামগ্না হইয়া কৃষ্ণের নাম লেখে ।।
তরুর অঙ্গে লতা দিয়া করায়ে মিলন ।
আঙ্গিক বলিয়া তাহে কহে কবিগণ ।।
পূর্বরাগের মুগ্ধা নায়িকার পক্ষে মৃত্তিকার উপরে চরণাঙ্গুলি দিয়ে আঁচড় কাটা অনুভাব রূপে গৃহীত হতে পারে। এইরূপ দু-চারটি আঙ্গিক মধ্যা ও প্রগলভা নায়িকার মধ্যেও দেখা যায়। এমনকি অনভিজ্ঞা রমণীর পূর্বরাগে আঙ্গিকের এমন দু-একটি স্বাভাবিক বা চেষ্টাকৃত রূপের সন্ধান সহজেই মেলে। রসকল্পবল্লী গ্রন্থে গোপাল দাসের স্বরচিত একটি পদে আঙ্গিকের পাশাপাশি চাক্ষুষের উদাহরণও পাওয়া যায়।
থির বিজুরী বরণ গোরি পেখলু ঘাটের কূলে ।
কানড়া ছান্দে কবরী বান্ধে নবমল্লিকার ফুলে ।।
সই মরম কহিয়ে তোরে ।
আড় নয়নে ঈষৎ হাসনে ব্যাকুল করিল মোরে ।।
ফুলের গেড়ুয়া ধরয়ে লুফিয়া সঘনে দেখায় পাশ ।
উচ কুচ যুগে বসন ঘুচে মুচকি মুচকি হাস ।।
চরণ যুগল মল্ল তোড়ল সুন্দর যাবক রেখা ।
গোপাল দাস কয় পাবে পরিচয় পালটী হইলে দেখা ।।
চাক্ষুষ অভিযোগ হল সরল কথায় স্বচক্ষে দেখা। এই দেখার মধ্যে আছে নানা কারুকৃৎ। নায়িকার কটাক্ষে তো মদনের বাস। কামদেব চিত্রাঙ্গদার প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে তাকে অর্জুন লাভের বর দিয়েছিলেন – ‘তাই আমি দিনু বর / কটাক্ষে রবে তব পঞ্চম শর / মম পঞ্চম শর’। নেত্রের হাস্য, নেত্রের অর্দ্ধমুদ্রা, নেত্রান্তঘুর্ণন, নেত্রান্তের সঙ্কোচ, বক্রদৃষ্টি, বাম চক্ষুর দ্বারা অবলোকন এবং কটাক্ষ ইত্যাদির নাম চাক্ষুষ। শ্রীপাদ রূপ গোস্বামী কটাক্ষের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন –
যদ্ গতাগতিবিশ্রান্তির্বৈচিত্র্যেণ বিবর্ত্তনম্ ।
তারকায়াঃ কলাভিজ্ঞাস্তৎ কটাক্ষং প্রচক্ষতে ।।
নেত্রতারকার যে গতাগতিবিশ্রান্তি, অর্থাৎ লক্ষ্য পর্যন্ত গমন এবং পুনরাগমন ও গতাগতি মধ্যে লক্ষ্য সহ যে অল্পকাল স্থিতি ইত্যাদির চমৎকারিত্বরূপ বিবর্তন, রসজ্ঞেরা তাকেই বলেছেন কটাক্ষ। নাগরীগণ অর্থাৎ শহরের মেয়েরা কটাক্ষবিক্ষেপ শিক্ষা করেন বা এ বিষয়ে যথেষ্ট পটুও হন। কবি কালিদাস ভ্রূবিলাস অনভিজ্ঞা জনপদবধূগণের অর্থাৎ গ্রাম্য বালিকাদের কথা উল্লেখ করেছেন। মনে হয়, কটাক্ষ নারীর বিশেষ সহজাত বৈশিষ্ট্য। যাহোক, পূর্বরাগে ‘‘চাক্ষুষ’’ চেষ্টাকৃত এবং নেত্রস্মিতাদি কোন কোনটি স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব। এসকল ছাড়াও পূর্বরাগে নায়ক বা নায়িকা উভয় পক্ষ থেকেই অনুরাগ-পত্র প্রেরিত হতে পারে। একে বলে ‘কামলেখ’। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ বড়াই-এর হাত দিয়ে ‘পান-ফুল’ পাঠিয়ে ছিলেন শ্রীরাধাকে।
সাধারণ, সমঞ্জস ও প্রৌঢ় – এ তিনটি হল পূর্বরাগের প্রকার। কৃষ্ণের রূপ দর্শন করে তাঁর লাবণ্যে মুগ্ধ বিহ্বল-বিবশ হয়ে তাঁকে সম্ভোগ কামনায় এই রতির জন্ম। গাঢ় নয়, সাধারণী রতিতে জাত বলে এ হল সাধারণ পূর্বরাগ। কুব্জার পূর্বরাগ এই ধরনের। তিনি মথুরার সাধারণী রমণী মাত্র। তদুপরি কংসের মাল্যোপজীবিনী রূপে বন্দিনী। কিন্তু যে মুহূর্তে মথুরার রাজপথে সে কৃষ্ণকে দর্শন করেছে – তৎক্ষণাৎ কংসের নারকীয় অত্যাচার, ভয়াবহ রাজশক্তির প্রতাপকে উপেক্ষা করার শক্তি অর্জন করেছে। তার মনের গভীরে অঙ্কুরিত হয়েছে কৃষ্ণ প্রেম। সে কৃষ্ণকে বলেছে, আমি তোমার, – ‘তস্যৈবাহং’, আমাকে গ্রহণ করো। ইন্দ্রিয়জ পিপাসা চরিতার্থের বাসনা রয়েছে কুব্জার প্রণয়ের মূলে। কিন্তু অন্য কাউকে নয়, সে স্বয়ং কৃষ্ণকেই প্রার্থনা করেছে। ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতির ইচ্ছা’র মধ্যে অতি সামান্য হলেও বর্তমান থাকে ‘কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা’। কুব্জার এ আত্মসুখের জন্য অন্য পুরুষ কাম্য নয়। তাই এই রতি সাধারণী। এখানে সেজন্য সকল ভাবের গাঢ়তা তেমন দেখা যায় না।
কৃষ্ণের রূপ-গুণের কথা শ্রবণ করে কেবল তাঁকে সম্ভোগবাসনা নয়, শাস্ত্র মতে, কুলধর্ম রক্ষা করে, সমাজের অনুশাসন মেনে বিবাহ বন্ধনের মধ্য দিয়ে একান্ত নিজের করে পাওয়ার আকাঙক্ষা দেখা যায় – তুমি আমার – ‘মমৈবাসৌ’ – আমায় গ্রহণ করো। এই সামঞ্জস্যের জন্যই এর নাম হল সমঞ্জসা রতি। রূক্মিণী শ্রীকৃষ্ণকে দ্বারকায় পত্র লিখলেন – “আমি ক্ষত্রিয়া, তদুপরি কুমারী এবং রাজকন্যা। পাপ শিশুপাল আমাকে বিবাহ করতে এসেছে। তুমি এসো মাধব, আমাকে উদ্ধার কর, যেন সিংহের ভোগ্য শৃগালে স্পর্শ না করে। ওগো অজিত, তুমি গুপ্তভাবে বিদর্ভে এস। এস, কিন্তু একাকী নয়। এস তোমার অপরাজেয় যাদব সৈন্য এবং সেনাপতিগণকে সঙ্গে নিয়ে। এস, এসে শিশুপাল ও জরাসন্ধকে সসৈন্যে বধ করো। বীর্য্যশুল্কা আমি, আমাকে রাক্ষসবিধি অনুসারে বিবাহ কর। আমার প্রার্থনা পূরণ কর হে মাধব।” শ্রী রুক্মিনী কৃষ্ণের পরিণীতা পত্নী। এরূপে লক্ষ্মীরূপা অপর মহিষীগণ, সত্যভামা প্রভৃতির সমঞ্জসা রতি। সমঞ্জসা রতির পূর্বরাগে অভিলাস, চিন্তা, স্মৃতি, গুণকীর্ত্তন, উদ্বেগ, বিলাপ, উন্মাদ, ব্যাধি এবং জড়তা প্রভৃতি ক্রমশঃ উৎপন্ন হয়। সমঞ্জসা নায়িকার অভিসারাদি নেই।
আর প্রৌঢ় পূর্বরাগ আগের দুই ধরণের চেয়ে অনেক উচ্চস্তরের। স্বসুখবাসনা শূন্য, কৃষ্ণপ্রীতি-ইচ্ছার অভিলাষ পূরণের একমাত্র আকাঙ্ক্ষাতেই এই রতির উন্মীলন। সমর্থা রতিতে জাত এ পূর্বরাগকে বলা হয় সমর্থ বা প্রৌঢ় পূর্বরাগ। ব্রজগোপীদের পূর্বরাগ সমর্থা রতির। এই রতিই বৈষ্ণব শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ। আর শ্রীরাধিকা নিত্যপ্রেয়সীদের মধ্যে সর্বোত্তমা – ‘সর্বগুণখনি সর্বকান্তশিরোমণি’। নারীধর্ম, কুলধর্ম, সমাজধর্ম, গৃহধর্ম, দেহধর্ম – এক কথায় সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে শ্রীরাধা এবং তাঁর অংশ স্বরূপা অনুগামিনী ব্রজবালাগণ কৃষ্ণের জন্যই কৃষ্ণকে ভালোবেসেছেন। তাই এই রতি রাগাত্মিকা রতি। এর অপর নাম প্রৌঢ়রতি।
পূর্বরাগ ঘনীভূত হলে লালসা, উদ্বেগ প্রভৃতি দশ প্রকার দশা উপস্থিত হয় – লালসা, উদ্বেগ, জার্গয্যা, তানব, জড়িমা, বৈয়গ্র, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ এবং মৃত্যু –
লালাসোদ্বেগজাগর্যা তানবং জড়িমাত্র তু ।
বৈয়গ্র্যং ব্যাধিরুন্মাদো মোহো মৃত্যুর্দশা দশ ।।
প্রৌঢ়ত্বাং পূর্বরাগস্য প্রৌঢ়া সর্বদ্দশা অপি ।। (উজ্জ্বলনীলমণি)
অন্নদামঙ্গলের কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর ‘রসমঞ্জরী’তেও অনুরূপ বলেছেন –
অঙ্গ সঙ্গ হওনের পূর্বে যে লালস ।
তারে বলি পূর্বরাগ তাহে দশা দশ ।।
পূর্বরাগের প্রৌঢ়তার কারণে এ সকল দশাও প্রৌঢ় হয়। অভীষ্ট বস্তুকে লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে বলে লালসা – ‘অভিষ্টলিপ্সয়া গাঢ়গৃধ্নুতা লালসো মতঃ’। এই দশায় উৎসুক্য, চপলতা প্রভৃতি ভাবের উদয় হয়। এই স্তরে প্রাপ্তির উৎকণ্ঠা তীব্র হলেও তা মনের গোপনেই বিরাজ করে। কিন্তু উদ্বেগ দশায় দীর্ঘশ্বাস, চাঞ্চল্য, স্বেদ, অশ্রু প্রভৃতি প্রকাশ পায় – ‘উদ্বেগো মনসঃ কম্পস্তত্র নিশ্বাসচাপলে’। এ প্রসঙ্গে একটি পদের উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে রাধিকার লালসোদ্বেগের কথা সখীরা বলছেন কৃষ্ণকে-
শুনইতে চমকই গৃহপতি রাব ।
তুয়া মঞ্জীর-রব উনমতি ধাব ।।
নাহ না চিহ্নই কাল কি গোর ।
জলজ নেহারি নয়নে ঝরু লোর ।।
কাঁহা তঁহু গোরি আরাধলি কান ।
জানলুঁ রাই তোহে মন মান ।।
স্বামিক শ্যন মন্দিরে নাহি উঠই ।
একলি গহন কুঞ্জ যাহা লুঠই ।।
পতি কর পরশে মানয়ে জঞ্জাল ।
বিজনে আলিঙ্গই তরুণ তমাল ।।
অর্থাৎ গোবিন্দদাসের এই পদে সখীরা বলছে, শ্রীরাধিকার স্বামী গৃহপতি মাত্র, তার সঙ্গে প্রণয়ের যোগ নেই বলেই তার শব্দে রাধিকা ভয়ে চমকে ওঠেন। অথচ তোমার নূপুরধ্বনি শুনে উন্মত্তের মতো তোমায় দেখার জন্য ছুটে যান। রাধিকা জানেন না তাঁর পতি কালো নাকি গৌর, কারণ তিনি পতির দিকে চোখ তুলে তাকান নি কখনো। কিন্তু মেঘের সঙ্গে তোমার বর্ণের সাদৃশ্য আছে বলেই মেঘ দেখে তার দুচোখ বেয়ে নামে অশ্রুধারা। তিনি তো স্বামীর শয়ন মন্দিরের দিকেও যান না, কিন্তু তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন বলে গহন কুঞ্জবনে গিয়ে তোমার সাক্ষাৎ না পেয়ে ভূলুণ্ঠিত হন। পতির হস্ত স্পর্শ তাঁর জঞ্জাল বোধ হয়, অন্যদিকে তোমার সঙ্গে মিল আছে বলে তমাল তরুকে আলিঙ্গন করেন।
জাগর্য্যায় দেখা যায় নিদ্রার অভাব – ‘নিদ্রাক্ষয়স্তু জাগর্য্যা স্তম্ভশোষগদাদিকৃৎ’। তানব অর্থে বোঝায় অঙ্গের কৃশতা – ‘তানবংকৃশতাগাত্রে দৌর্বল্যভ্রমণাদিকৃৎ’। উৎকণ্ঠা ,চিন্তা, নিদ্রার অভাব ইত্যাদি কারণে শরীর দুর্বল ও কৃশ হয়ে পড়ে। জড়িমা স্তরে নায়িকার ইষ্ট-অনিষ্টের জ্ঞান থাকে না, দর্শন ও শ্রবণশক্তি লুপ্ত হয়ে যায় –
ইষ্টানিষ্টাপরিজ্ঞানং যত্র প্রশ্নেষ্বনুত্তরম্ ।
দর্শন-শ্রবণাভাবো জড়িমা সো’ভিধীয়তে ।।
ভাবোৎকণ্ঠার তীব্র আলোড়নে মন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বৈয়গ্র দশায়। বৈয়গ্র হল ভাবগাম্ভীর্যের কারণে সৃষ্ট বিক্ষোভজনিত অসহিষ্ণুতা। এই দশায় হৃদয় বেদনা একান্ত অসহনীয় হয়ে ওঠে – ‘বৈয়গ্র্যং ভাবগাম্ভীর্য্যবিক্ষোভাসহতোচ্যতে’। আর ইষ্টের অপ্রাপ্তিতে শরীর যখন উতপ্ত হয়, পাণ্ডু বর্ণ ধারণ করে, সেই অবস্থার নাম ব্যাধি – ‘অভীষ্টলাভতো ব্যাধিঃ পাণ্ডিমোত্তাপলক্ষণঃ’। উন্মাদ দশায় সর্বদাই দেখা যায় তন্ময়ভাব, ফলে ভ্রান্তি জন্মায়। ‘মোহো বিচিত্ততা প্রোক্তো নৈশ্চল্য-পতনাদিকৃৎ’ -অর্থাৎ মোহ হল বিচিত্ততা বা চিত্তের বিপরীত গতি। মোহ চেতনারহিত। ফলে পতন বা মূর্চ্ছা প্রাপ্ত হয়। অন্তিম দশা হল মরণ। দূতী প্রেরণ বা পত্র প্রেরণের মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করার পরেও কান্তের আগমন না ঘটলে কন্দর্পবাণের পীড়নে মরণ দশা প্রকটিত হয়। নায়কের সঙ্গে নায়িকার যদি একান্তই মিলন না ঘটে তবে অবশেষে মৃত্যু আসে। কিন্তু পদাবলী সাহিত্যে বা অন্যত্র কোথাও এই শেষ দশার অবতারণা করা হয়না, এতে রসভঙ্গ হয়। তবে প্রত্যেকটি দশার মধ্য দিয়ে তীব্র আকর্ষণ সূচিত হয়। প্রেমাঙ্কুরের মধ্যে ভাবী বনস্পতির প্রত্যক্ষ আভাস পাওয়া যায় পূর্বরাগের এই দশ দশার মাধ্যমে।
শ্রীরাধার পূর্বরাগ
পূর্বরাগ হল মধুররসের সূচনা স্তর। কৃষ্ণকে দেখে বা তার কথা শুনে শ্রীরাধার হৃৎমাঝারে মধুররসের উন্মোচন সাধারণ দৃষ্টিতে প্রাকৃত নায়ক-নায়িকার প্রেমচেতনার মতো হলেও আসলে তা অলৌকিক। শ্রীরাধার পূর্বরাগ প্রথম থেকেই হৃদয়ের অতি গভীর স্তরে সঞ্জাত। ‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে, অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে’ – রাধাকৃষ্ণের যুগল প্রেমের রভসলীলা সেই অনাদিকালের হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়ে বয়ে চলেছে আবহমান যুগ ধরে। তবুও এই অনাদি প্রেমের সূচনা স্তর রূপে পূর্বরাগকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কৃষ্ণ প্রেমের এমনই মহিমা, মধুরতা, এমনই তার আকর্ষণ যে তাঁকে দর্শন বা নাম শ্রবণ মাত্রই রাধিকার হৃদয় মন উন্মোথিত হয়ে ওঠে। শ্রীমদ্ভাগবতে ধেনুকাসুর বধের দিনে কৃষ্ণকে দেখে ব্রজবালাদের মনে পূর্বরাগের উদয় হয়। যদিও দেখা যায় কৃষ্ণের পূর্বরাগ পূর্বে উদয় হয়েছিল তথাপি শ্রীপাদ শুকদেব গোস্বামী গোপবালাদের কথাই পূর্বে বর্ণনা করেছেন। আচার্যগণও বলেছেন, কৃষ্ণলীলার আবেশে মথিত কবিহৃদয় লীলার পৌর্বাপর্য রক্ষা করতে পারেনি। তাছাড়া মনে হয় গোপীগণের পূর্বরাগ লীলার চারুতা অধিক স্বাদু। চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের পদে শ্রীরাধিকার ভাবগভীর মূর্তি, প্রেমের সূচনাতেই বিরহের পদসঞ্চার – বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে / যেমত যোগিনী পারা। জ্ঞানদাসের পদে স্বপ্নে দর্শনের মনোরম চিত্র –
রজনী শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে ।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে
নিন্দ যাই মনের হরিষে ।।
শিয়রে শিখণ্ড রোল এপাশে মত্ত দাদুরী বোল
কোয়িল কুহরে কুতূহলে।
ঝিঞ্ঝা ঝিনিক বাজে ডাহুকী সে গরজে
স্বপন দেখিনু হেনকালে ।।
স্বপন দেখিনু যে শ্যামল বরণ দে
সেহ বিনে মোর কেহ নয়।
শ্রীরাধার পূর্বরাগের একটি সাক্ষাৎ দর্শনের পদ উল্লেখ করতে বড় ইচ্ছে করছে – তিনি যমুনার কূলে জল ভরতে গিয়ে তরুমূলে দেখেছেন ত্রিপুরারি ত্রিভঙ্গ মুরারিকে। দেখে মন হয়েছে উচাটন। তিনি সখীদের বলেছেন –
সজনি কি হেরিনু যমুনার কূলে।
ব্রজকূল নন্দন, হরিল আমার মন, ত্রিভঙ্গ দাঁড়ায়ে তরুমূলে ।।
গোকুল নগরী মাঝে, আর কত নারী আছে, তাহে কোন না পড়িল বাধা ।
নিরমল কুলখানি, যতনে রেখেছি আমি বাঁশী কেন বলে রাধা রাধা ।।
মল্লিকা চম্পকদামে, চূড়ার টালনি বামে, তাহে শোভে ময়ূরের পাখে ।
আশে পাশে ধেয়ে ধেয়ে, সুন্দর সৌরভ পেয়ে, অলি উড়ে পড়ে লাখে লাখে ।।
সে কি রে চূড়ার ঠাম, কেবল যেন কাম, নানাছান্দে বান্ধে পাক মোড়া ।
শিব বেড়া বেনানী জালে, নবগুঞ্জা মণিমালে, চঞ্চল চাঁদ উপরে জোড়া ।।
পায়ের উপর থুয়ে পা, কদম্বে হিলন গা, গলে শোভে মালতীর মালা ।
বড়ু চণ্ডীদাসে কয়, না হইল পরিচয়, রসের নাগর বড় কালা ।।
যদুনন্দনের পদে দেখি পূর্বরাগের উন্মাদ অবস্থা –
খেনে হাসয়ে খেনে রোয়ে ।
দিশি দিশি হেরয়ে তোয়ে ।।
খেনে আকুল খেনে থীর ।
খেনে ধারই খেনে গীর ।।
আবার রসোদ্গারের পদে গোবিন্দদাস বলেছেন –
আধক আধ আধ দিঠি অঞ্চলে
যব ধরি পেখলুঁ কান ।
কত শত কোটী কুসুমশরে জরজর
রহত কি শত পরাণ ।।
এভাবে মানুষী প্রণয়ের সীমানা ছাড়িয়ে রাগানুগা প্রণয়ের আশ্চর্য বিহ্বলতার প্রকাশ শ্রীরাধিকার পূর্বরাগে।
শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগ
শ্রীরাধিকার ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগও বৈষ্ণব পদাবলীর চর্চিত বিষয়। পূর্বরাগের সকল লক্ষণ, দশ দশার ক্রমও দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগে। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে, কালীয়দমনের দিনে গোপীদের দেখে মাধবের মনে পূর্বরাগের উদয় হয়। শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগের পদে সাধক কবি গোবিন্দদাস বলেছেন,
কালি-দমন মাহ ।
কালিন্দীতীর কদম্বক ছাহ ।।
কতশত ব্রজ নব বালা ।
পেখলুঁ জনু থির বিজুরিক মালা ।।
তঁহি ধনীমণি দুই চারি ।
তঁহি মনোমোহিনী এক নারি ।।
সো অব মঝু মন পৈঠে ।
মন্সিজ ধুমেহু ঘুম নাহি দিঠে।।
আবার চণ্ডীদাস যেমন কৃষ্ণ নাম শুনিয়ে রাধিকার মনে পূর্বরাগের উন্মেষ ঘটিয়েছেন তেমনি বড়াই-এর মুখে রাধার রূপের কথা শুনে কৃষ্ণের অন্তরে ঘটেছে প্রেমের উন্মেষ –
তোর মুখে রাধিকার রূপ কথা শুনি। ধরিবারে না পারোঁ পবাণি ।
দারুণ কুসুম শর সুদৃঢ় সন্ধানে। অতিশয় মোর মনে হানে ।।
শ্রীকবিরঞ্জনের পদে আছে শ্রীকৃষ্ণের রাধাকে সাক্ষাৎ দর্শনের অনুভূতির কথা –
যব গোধূলি সময় বেলি, ধনি মন্দির বাহির ভেলি ।
নব জলধর বিজুরি রেহা নন্দ পসারিয় গেলি ।।
ধনি অলপবয়সি বালা, জনু গাথনি পহুপ মালা ।
থোরি দরশনে, আস না পুরল, বাঢ়ল মদনজ্বালা ।।
পূর্বরাগে রাধা-কৃষ্ণ উভয়ের অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে দূতী প্রেরণ। উভয়েরই রয়েছে ‘আপ্তদূতী’। নায়ক-নায়িকা প্রেরিত বিশ্বস্তা দূতীই ‘আপ্তদূতী’। তবে কে আগে দূতী প্রেরণ করবে তা নিয়ে বাধা-নিষেধ কিছু নেই। পূর্বরাগে শ্রীকৃষ্ণের ‘স্বয়ং দৌত্য’ আছে। তবে মানের পরে কৃষ্ণের ‘স্বয়ং দৌত্য’-এর পদই অধিক প্রসিদ্ধ। পূর্বরাগান্তে যে মিলন হয়, তা ‘সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ’ নামে পরিচিত। মিলনের পর প্রেম প্রগাঢ় হলে শ্রীরাধাও ‘স্বয়ং দৌত্যে’ অগ্রসর হন। অবশ্য বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে শ্রীরাধার ‘স্বয়ং দৌত্য’ অভিসারের নামান্তর।
পূর্বরাগ হল সেই সোপান, যেখান থেকে অনন্ত প্রেমলোকের পথে ভক্ত তার ভালোবাসার সবটুকু নিবেদনের যাত্রা শুরু করে। ‘আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি’ – এই সব দেওয়ার নামই তো প্রেম। আর এই প্রেমের সূচনা পূর্বরাগের মধ্য দিয়ে। ‘কে সে মোর কেইবা জানে/ কিছু তার বুঝি না বা কিছু পাই অনুমানে’ – এই বোঝা আর না বোঝার দোদুলদোলার তরী বেয়ে কৃষ্ণ প্রেমের সাগরের তীরে এসে দাঁড়ানোর নামই তো পূর্বরাগ।