‘রস’ বলিতে আমরা সাধারণতঃ বুঝি ‘আনন্দ’৷ জড়জগতের রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শের মধ্যে দ্বিতীয়টি আমার জিহ্ববার দ্বারা আস্বাদন করিতে পারি৷ এইজন্য ইহার এক নাম রসনা৷ কটু তিক্ত কষায় লবণ অম্ল মধুর এই ছয়টি রসনেন্দ্রিয়গ্রাহ্য রস৷ আবার যাহা মনের আস্বাদ্য তাহাও রস নামে পরিচিত৷ কোনও বস্তু দর্শন করিলে বা কোনও চিন্তা চিত্তে উদিত হইলে যে অনির্বচনীয় আনন্দ অন্তঃকরণে অনুভূত হয়, তাহাকেও রস বলা হয়৷ কাব্যপাঠে বা অভিনয়দর্শনেও এইরূপ আনন্দ মনোমধ্যে উদিত হয়৷ সেইজন্য অলংকার-শাস্ত্রে নয় প্রকার রসের উল্লেখ আছে : আদি, বীর, করুণ, অদ্‌ভূত, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র ও শান্ত৷ বাৎসল্যরস গণনা করিলে রসের সংখ্যা হয় দশ৷ বৈষ্ণবদের মতে সাহিত্যের নয়টি রস গৌণ৷ মুখ্যরস পাঁচটি যথা – শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর৷ এখানেও রসের অর্থ -যাহা আস্বাদ্য, কিন্তু এ আস্বাদন প্রাকৃত বস্তুর নহে, ইহা পারমার্থিক আস্বাদন৷ কারণ এই অনিত্য সংসারে একমাত্র আস্বাদ্য বা উপভোগের বিষয় শ্রীকৃষ্ণ৷
রসিকশেখর কৃষ্ণ পরমকরুণ৷
– চৈতন্যচরিতামৃত
কীর্তনে এই রসের বিন্যাসদ্বারা শ্রীকৃষ্ণের উপভোগকেই বাস্তব রূপ দান করা হইয়াছে৷ পূর্বেই শান্ত দাস্য প্রভৃতি রসের উল্লেখ করা হইয়াছে; তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন৷ এখানে কীর্তনের রস প্রসঙ্গে ইহা বলা একান্ত আবশ্যক যে, কীর্তনের গীত যেরূপ এই রসবিভাগ অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া পড়ে, ভক্তও তেমনি ভিন্ন ভিন্ন রসের অধিকারীরূপে বিভক্ত; কেহ শান্ত, কেহ সখ্য, কেহ বা মধুর রসের অধিকারী৷ শান্তরস ভগবদ্‌ভক্তজনের মনের সাধারণ স্থায়িভাব৷ সংসারের অনিত্যতা এবং ইহার চিরচঞ্চল সুখদুঃখরূপ ছায়াবাজির স্বরূপ যতই অন্তঃকরণে উপলব্ধি হইবে, ততই চিত্ত প্রশান্ত স্থির অপ্রমত্ত হইয়া উঠিবে৷ সুতরাং এই বৈরাগ্যমিশ্রিত মনোভাব সমস্ত ভক্তচিত্তের স্বাভাবিক ভিত্তি, এইজন্য বৈষ্ণবেরা শান্তরসকে রসগণনায় শ্রেষ্ঠ স্থান দেন না৷ ইঁহাদের মতে চারিটি রস প্রধান–দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর৷
দাস্য সখ্য বাৎসল্য শৃঙ্গার চারি রস৷
চারি ভাবে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার বশ৷৷
… …
দাস্য সখ্য বাৎসল্য আর যে শৃঙ্গার৷
চারি ভাবে চতুর্বিদ ভক্তই আধার৷৷
নিজ নিজ ভাবে সবে শ্রেষ্ঠ করি মানে৷
নিজ ভাবে করে কৃষ্ণ সুখ-আস্বাদনে৷
– চৈতন্যচরিতামৃত, আদি

এইসকল রসের মধ্যে আবার আদি বা শৃঙ্গার অর্থাৎ মধুর রসই অধিক আস্বাদ্য৷ সেজন্য রসের গানই কীর্তনে অধিক৷
ভগবানকে ভজনা করিবার যে চারি প্রকার রীতি (রস) কথিত হইল,তাহার মধ্যে মধুর রসের ভক্তই সর্বাপেক্ষা অধিক৷ কিন্তু আমরা যদি মনে করি যে সকলেই মধুর রসের ভক্ত,তাহা হইলে ভুল হইবে৷ এমন বহু লোক দেখিয়াছি যাঁহারা মধুর রসের পদাবলী শ্রবণ করেন না৷ অর্থাৎ অভিসার, কলহান্তরিতা, মাথুর প্রভৃতি পালার গান হইলে তাঁহারা সে-স্থান ত্যাগ করেন৷ এমন অনেক ভক্ত আছেন যাঁহারা কেবল দাস্য, সখ্য ও বাৎসল্য রসের অধিকারী৷ শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলা তাঁহারা শুনেন না৷ দাস্য ও সখ্য রসের ভজন অন্যান্য ধর্মেও দেখিতে পাওয়া যায়৷ ভগবানকে প্রভু বা বন্ধু বলিয়া মনে করা সকল ধর্মেই চলে৷ কিন্তু বৈষ্ণবদের বাৎসল্য রসের তুলনা বোধ হয় বিরল৷ ভগবানকে সন্তান বলিয়া স্নেহ করা, সেইভাবে তাঁহার সেবা করা অন্যত্র প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় না৷ বাৎসল্য রসের সেবক যাঁহারা, তাঁহারা নন্দ-যশোমতীর অভিমানে ভাবিত হইয়া কৃষ্ণকে প্রতিপাল্য জ্ঞানে আদর করেন৷ এই বাৎসল্য রসের গান গোষ্ঠলীলা, উত্তরগোষ্ঠ প্রভৃতি পালায়, শুনিতে পাওয়া যায়৷ ভগবানকে অপত্যবুদ্ধির দৃষ্টান্ত অন্যত্র একান্ত বিরল৷ ভগবানকে পিতা বা মাতা বা বন্ধুভাবে ভজনা করিবার, দৃষ্টান্ত অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট দেখতে পাওয়া যায়৷ পতিভাবে ভজনা করিবার পদ্ধতিও অজ্ঞাত নহে৷ St.Catherine of Theresa এবং Carmelite Nunsদের মধ্যে যীশুখৃষ্টকে পতিভাবে উপাসনা করিবার প্রণালী দেখা যায়৷ ইঁহারা Brides of Christ বা খ্রীষ্ট্রের পাত্রী বলিয়া পরিচিত৷ কার্মেলাইট্‌ সন্ন্যাসিনীরা এতদূর ভাবাবিষ্ট যে তাঁহারা অন্য পুরুষের মুখাবলোকন পর্যন্ত করেন না৷ তাঁহারা যে-মঠে থাকেন সে-মঠে কোনও পুরুষের প্রবেশাধিকার নাই৷ যদি কখনও রাজমিস্ত্রী বা অন্য মজুরদের প্রবেশ আবশ্যক হয়, তখন তাহাদের গলায় ঘন্টা বাঁধিয়া দেওয়া হয় অথবা মঠাধিকারিণীদের পূর্বে সংবাদ দেওয়া হয় যাহাতে তাঁহারা নির্জন স্থানে অপেক্ষা করিতে পারেন৷
কিন্তু বৈষ্ণবদের বাৎসল্য রসটি অতি অপূর্ব ৷ এই রসের এবং অন্যান্য রসের বৈশিষ্ট্য এই যে, স্বার্থের কোনও সন্ধান ইহার মধ্যে নাই৷ সাংসারিক হিসাবে পুত্রের প্রতি মাতৃস্নেহের মধ্যে যতই আত্মবিস্মৃতি থাকুক, ইহা একেবারে বিশুদ্ধ হইতে পারে না৷ কিন্তু ভগবানের প্রতি নন্দ-যশোদার যে অপত্যস্নেহ, উহা একান্তভাবে বিশুদ্ধ অর্থাৎ কিছুমাত্র স্বার্থের সন্ধান উহাতে ছিল না৷ আমার যাহা হয় হউক, পুত্র আমার যেন কিছুমাত্র কষ্ট না পায়— এইরূপভাবে ভগবৎসেবা বিশুদ্ধ বাৎসল্যরসের উপজীব্য ৷
রসাভাস–রসের আভাসমাত্র বর্তমান অথচ যেখানে প্রকৃত রসের অভাব তাহাকে রসাভাস বলে৷ রসাভাস বা রসদুষ্টি বা অনুচিত রস কীর্তনে অত্যন্ত দোষাবহ৷ কীর্তনিয়াকে অতি সন্তর্পণের সহিত এই রসাভাস-দোষ পরিহার করিতে হয়৷ মন করুন, কীর্তনিয়া মধুর বা আদিরসের গান করিতেছেন, এমন সময়ে যদি তিনি পরকালে কথা উপস্থাপিত করেন, তারা হইলে সে গান অত্যন্ত শ্রুতিকটু হয়৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, যখন রূপ-গুণ-যৌবনশালিনী গোপবালারা যমুনাতীরে পারে যাইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন, তখন যদি গায়ক নাবিকরূপী শ্রীকৃষ্ণকে দিয়া বলান যে তিনি ভবপারের কর্ণধার, জীবকে ভবপারে লইয়া যাইবার জন্য অনাদি কাল হইতে তিনি খেয়া দিতেছেন, তাহা হইলে সেখানে রাসভাস-দোষ বা রসভঙ্গ হইল বলিতে হইবে৷ মনে করুন, বাসরঘরে বরকে ঘেরিয়া কুটুম্বিনীর দল আনন্দোল্লাসে মগ্না, বরকে গান গায়িবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেছেন, তখন বর যদি গান ধরেন,
বাঁশের দোলাতে চড়ে কে হে বটে
যাচ্ছ তুমি শ্মশানঘাটে৷
তাহা হইলে তাহা যেমন শ্রুতিকটূ হয়, কীর্তনে রসাভাস অনেক সময়ে তেমনি রসপুষ্টির বিরোধী হইয়া পড়ে৷
বৈষ্ণবশাস্ত্রে রস এক অপূর্ব সৃষ্টি৷ উহার বিভাব, অনুভাব সঞ্চারিভাব আদি ক্রম অনুশীলন না করিলে কীর্তন সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না৷ পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে, তাহাতে এই বিষয়টি পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করিয়াছি যে,মহাজনপদাবলী সুরলয় সংযোগে শ্রুতিমধুররূপে পরিবেশন করিলে, তাহাকেই উচ্চাঙ্গের কীর্তন বলে৷ মহাজনপদাবলীর মধ্যে প্রধান রস শৃঙ্গাররস৷ সখ্য বাৎসল্য ও দাস্যরসের বহু পদ থাকিলেও গানের পক্ষে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হইতেছে পদাবলীর আদিরস৷ অর্থাৎ অধিকাংশ পদাবলী প্রেমকবিতা৷ এই প্রেমকবিতা রাধাকৃষ্ণ ও তাঁহাদের সখীবৃন্দাকে কেন্দ্র করিয়া রচিত৷ সুতরাং প্রত্যেকটি পদেই আধ্যাত্মিক ইঙ্গিত আছে — অর্থাৎ প্রত্যেক রসেরই প্রবাহ চলিয়াছে সে অনন্ত সাগর -পানে যেখানে সকল হৃদয়বৃত্তি বাঞ্ছিতকে পাইয়া চরমচরিতার্থতা লাভ করে৷ কিন্তু কীর্তনের সর্বপ্রধান সতর্কতা আবশ্যক হয় এইখানে৷ রাধাকৃষ্ণের প্রেমবর্ণনায় যথাসম্ভব আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বর্জন করিয়া গান করিতে না পারিলে কাব্যের মাধুর্য এবং গীতের সার্থকতা উভয়ই নষ্ট হইয়া যায়৷ এখানেই বৈষ্ণব-কবি এবং বৈষ্ণব-গায়কের চরম পরীক্ষা৷ বৈষ্ণব-কবি পরমার্থতত্ত্ব বলিবেন প্রেমের মধ্য দিয়া, স্নেহের মধ্য দিয়া, আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়া৷ কিন্তু তিনি কাব্যের রাসমাধুর্য নষ্ট করিতে চাহেন না৷ কাব্যহিসাবে, রসপরিবেশন হিসাবে তাঁহার কাব্য উপভোগ্য হইবে, অথচ তাহার মধ্যে থাকিবে প্রিয়তমের সান্নিধ্যলাভের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা৷ এই যে সর্বপ্রকার বাধাহীন সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রেম, শ্রীজীবগোস্বামী ইহাকে মুক্তি অপেক্ষাও সুদুর্লভ বলিয়াছেন৷ এই অপ্রাকৃত প্রেমের গীত কীর্তন, অথচ কীর্তন-গায়ক যদি সে কথা স্পষ্টভাষায় প্রকাশ করেন, তবেই তাঁহার কীর্তন ব্যর্থ হইল৷ সহজ প্রেমকেই আখরের সাহায্যে ফুটাইয়া তুলিতে হইবে; কবি যে চিত্রটি আঁকিয়াছেন, তাহারই সৌন্দর্য ও মাধুর্য কীর্তনিয়া পরিবেশন করিবেন তাঁহার শিল্পশৈলীর দ্বারা৷ তত্ত্ব ও লীলার সঙ্গে যে নিগূঢ় রহস্যময় সম্বন্ধ আছে, কথকতায় বা ভাগবত-ব্যাখ্যায় বক্তা তাহা পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করেন কিন্তু কীর্তনিয়া লীলার চমৎকারিত্ব বর্ণনা করিবেন, তত্ত্বকথার দ্বারা তাহাকে রূপকমাত্রে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবেন না৷ একটি দৃষ্টান্ত দিলে কথাটি সহজে বুঝিতে পারা যাইবে—

সেই কেবা শুনাইলে শ্যামনাম৷
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ৷৷

এই গানে নামের মাহাত্ম্য বা প্রতাপ বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু এই মধুর পদটি গান করিতে গিয়া যদি কেহ শ্যামনাম-মাহাত্ম্য প্রচার করিয়া পরকালের পাথেয় সঞ্চয় করিবার উপদেশ দেন, তবে তাঁহার গান অশ্রাব্য হইবে৷ তাহার কারণ ঐ গানটির কবিত্বই সর্বাগ্রে উপভোগ্য,উহার মধ্যে যে কবিত্বপূর্ণ প্রেমতন্ময়তা আছে তাহাই পরম আস্বাদ্য, তাহাকে ক্ষুণ্ণ করিবার অধিকার কীর্তনিয়ার নাই৷
কীর্তনে আখর— রসাভাস-দোষ অতি সন্তপর্ণে পরিহার করিতে হয় বলিয়াছি৷ তাহার কারণ এই যে কীর্তনগানটি যেমন রচিত হইয়াছে, তেমনি গান করিলেই হয় না৷ অন্য সংগীতের সঙ্গে কীর্তনের একটি মুখ্য বৈলক্ষণ্য এই যে এই গানে গায়ক ইচ্ছামত অলংকার বা আখর (অক্ষর) যোজনা করিতে পারেন৷ গানের অর্থ বিশদ করিবার জন্য, অন্তর্নিহিত ভাবকে পরিস্ফুট করিবার জন্য, রচয়িতার গূঢ় মনোভাবকে সুরের বেদনায় প্রকাশ করিবার জন্য আখর দেওয়া হয়৷ গায়ক নিজে যাহা যোজনা করেন, তাহাই আখর৷ কোনও কোনও সময় সুরের পোষকতায় আখরের স্থলে পদের অংশবিশেষের পুনরাবৃত্তিও করা হয়— অর্থাৎ গায়ক নিজের কথা না জুড়িয়া পদকর্তার ভাষাই হুবহু ব্যবহার করেন— তাহাকেও ‘আখর’ বলা হয়৷ কিন্তু আখর অর্থে প্রধানতঃ গায়কের স্বকীয় যোজনা৷ অনেক সময়ে এইসকল আখর পূর্ববর্তী গায়কেরা রচনা করিয়া গিয়াছেন, বর্তমান গায়ক তাহারই আবৃত্তি করেন৷ আবার অনেক সময়ে গায়ক নিজ উদ্‌ভাবনী শক্তির সাহায্যে ভাবপোষক কথা সংযোজিত করেন৷ গায়কের কবিত্বশক্তি ও সুরতালের নৈপুণ্য থাকিলে এই সকল আখর অনেক সময়ে তত্তৎ পদাবলী অপেক্ষাও শ্রুতিমধুর হয়৷ কিন্তু এইখানেই বিপদ ! অনেক অল্পশক্তিসম্পন্ন লোক আখর-যোজনার প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া এমনকথা হয়তো বলিয়া ফেলেন, যাহা রস-পরিপোষক তো নয়ই,বরং তাহার বিপরীত৷ সে সকল স্থলে রসিকসমাজ অত্যন্ত মর্মাহত হন৷ এই জন্যই আখর দিবার প্রলোভন সংযত না করিলে কীর্তনগান পীড়াদায়ক হইয়া উঠিতে পারে৷ কারণ রসিক ভক্তগণ এরূপ রসাভাসদোষ সহ্য করেন না৷
কীর্তনের এক-একটি পালা একটি খণ্ডকাব্য৷ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের কোনও একটি লীলা কয়েকটি মহাজনপদাবলীর সাহায্যে জীবন্তভাবে চিত্রিত করাই কীর্তনের উদ্দেশ্য৷ পূর্বেই এইসকল পালার সম্বন্ধে উল্লেখ করিয়াছি৷ কিন্তু কি ভাবে এই পালাগান নিষ্পন্ন হয়, তাহা বলা হয় নাই৷ সাধারণতঃ কীর্তনগায়ক বিভিন্ন পদকর্তার বিভিন্ন পদ বাছিয়া তাহাই পালার আকারে সাজাইয়া লন৷ বস্তুতঃ যাত্রার পালা যেমন নির্দিষ্ট গান ও কথোপকথনের মধ্য দিয়া নির্বাহিত হয়, কীর্তনের পালা সেরূপ নহে৷ মনে করুন অনুরাগের এক পালা গান হইবে; গায়ক ইচ্ছামত একটি ‘তদুচিত’ গৌরচন্দ্রিকা বাছিয়া লইলেন—
কি ক্ষণে দেখিলাম গোরা নবীন কামেরি কোঁড়া
সেই হইতে রইতে নারি ঘরে৷ ইত্যাদি৷
– লক্ষ্মীকান্ত

তার পরে তিনি গায়িতে পারেন—
বেলি অবসানকালে একা গিয়াছিলেন জলে৷ ইত্যাদি৷
– বসু রামানন্দ

অথবা —
চিকণ কালিয়া রূপ মরমে লেঘেছে গো
ধরণে না যা মোর হিয়া ৷
– জ্ঞানদাস

অথবা—
রূপে ভরল দিঠি সোঙারি পরশ মিঠি
পুলক না তেজই অঙ্গ৷
– গোবিন্দ দাস

অতএব বুঝা যাইতেছে যে, গায়ক মহাজনপদাবলী হইতে বিভিন্ন পদকর্তার পদ লইয়া নিজের ইচ্ছামত পালা সাজাইয়া থাকেন৷ এইরূপ সাজাইতে গিয়া কিন্তু পৌর্বাপর্য রক্ষা করা একান্ত আবশ্যক৷ এখানে গায়কের নিপুণতা ধরা পড়ে৷ তাঁহার যদি অনুক্রম-জ্ঞান না থাকে, তবে তাঁহার সে গানও রসাভাসদুষ্ট হইয়া পড়ে৷ এই দোষ হইতে অব্যাহতিলাভ করিবার জন্য কীর্তনগায়ক নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর না করিয়া অনেক সময়ে পূর্ববর্তী মহাজনদের অনুসরণ করেন, অর্থাৎ যে সব পালা আঘে হইতে সাজানো আছে, তাহারই অনুবৃত্তি করেন৷