বৈঠকী গানে রাগরাগিণীর যেরূপ ক্রম আছে, কীর্তনেও সেইরূপ৷ অর্থাৎ কীর্তনগান ভারতীয় সংগীত-পদ্ধতিরই অন্তর্গত৷ তবে হিন্দুস্থানী গানের রাগরাগিণীতে বর্তমানে যে ধরাবাঁধা সর্গম দেখা যায়, কীর্তনে তাহা সব সময়ে অনুসৃত হয় না৷ এজন্য হিন্দুস্থানী পদ্ধতির গায়কেরা অনেকে কীর্তনকে উচ্চস্থান দিতে সম্মত হন না৷ কিন্তু একটু প্রণিধান করিলে দেখা যায় যে, কীর্তন এক অভিনব ঠাটের সংগীত৷ কোনও পদ্ধতিবিশেষকে হুবহু অনুসরণ করিলে, শ্রেণীবিভাগে তাহার স্বতন্ত্র স্থান হয় কিরূপে? একটি উদাহরণ দিলে হয়তো আমার বক্তব্য বুঝিবার পক্ষে সুবিধা হইবে৷ সন্দেশ এবং রসগোল্লা উভয়ই সুস্বাদু মিষ্টান্ন; উপাদনও উভয়ের এক, কিন্তু সন্দেশ রসগোল্লা নহে এবং রসগোল্লাও সন্দেশ নহে৷ স্বাদুতার উৎকর্ষ রুচি হিসাবে; কেহ সন্দেশ, কেহ বা রসগোল্লার ভক্ত৷ রাগরাগিণী সম্বন্ধে কীর্তনের উপাদান যে এক, ইহা জয়দেবের পদাবলী হইতে আরম্ব করিয়া কমলাকান্ত, দীনবন্ধু দাস পর্যন্ত সমস্ত পদাবলীর সাংগীতিক নির্দেশ দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়৷ কোনও গানে গুর্জরী বা মালব, কোনও গানে ঝিঁঝিট খাম্বাজ বা সিন্ধুড়া, কোনও গানে জয়জয়ন্তী বেহাগ বা বিহাগড়া৷ এক্ষণে কথা এই যে, যে সকল রাগরাগিণীর নির্দেশ পদাবলীতে পাওয়া যায়, তাহা কি ঐ ঐ রাগরাগিণীর লক্ষণ অনুসারে গীত হয়, অথবা গায়কগণ নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে তাহাকে অন্যরূপ করিয়া লয়েন ?
কীর্তনের যে রীতি বর্তমানে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে প্রাচীন রাগ-রাগিণীর সমস্ত অবয়ব অনেক সময়ে ঠিক ঠিক মত পাওয়া যায় না। কীর্তন-গায়ক যে সুরকে মল্লার বা বসন্ত বলিয়া ব্যাখ্যা করিলেন, সে সুরে মল্লার বা বসন্তের সবগুলি পর্দা হয়তো পাওয়া যায় না৷ তবে ভীমপলশ্রী,ঝিঁঝিট, বেহাগ, জয়জয়ন্তী প্রভৃতি কতকগুলি রাগিণীতে বৈঠকী রীতিরই অনেকটা অনুবর্তন করা হয়৷ এই যে পার্থক্য, কোন কোন সংগীতজ্ঞ ইহাকে ব্যভিচার বলিয়া মনে করেন এবং কীর্তনগানকে সংগীতের কোঠায় নিম্নস্থান প্রদান করেন৷
এখন দেখা যাউক, এই মত কতটা যুক্তিযুক্ত৷ এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, বর্তমানে যে কীর্তন প্রচলিত আছে তাহাতে রাগ-রাগিণীর প্রতি নিষ্ঠা তাদৃশ দেখা যায় না৷ আলাপচারি দ্বারা সর্গম করিয়া তত্তৎ রাগিণীতে গান করিলে অনেক সময়ে পার্থক্য ধরা পড়ে৷ কিন্তু খুব কম কীর্তনিয়া সর্গমের দিকে দৃষ্টি দিয়া থাকেন৷ কীর্তনে স্বরলিপি ব্যবহার একরূপ নাই বলিলেই চলে৷ সেজন্য অভিজ্ঞের নিকট সুরের অঙ্গহানি সহজেই প্রতিভাত হয়৷ এরূপ কেন হয়, তাহারই কয়েকটি কারণ উল্লেখ করিতেছি—
প্রথমতঃ কীর্তন এক অভিনব প্রণালী বা ঠাটের সংগীত৷ কাজেই সুর-সংস্থানে ইহাকে অনেকটা স্বতন্ত্রভাবে চলিতে হইয়াছে৷ অর্থাৎ প্রচলিত রীতিকে ইচ্ছামত পরিবর্তন করিয়া লইতে হইয়াছে৷
দ্বিতীয় কারণ এই যে, বর্তমানে কীর্তনিয়ার অজ্ঞতাবশতঃ সুরপরিচয়ে বিভ্রাট ঘটিয়াছে৷ অর্থাৎ কীর্তনিয়া যখন বলিলেন শংকরাভরণ বা বৃন্দাবনী সারঙ, তখন তাহার সহিত তত্তৎ রাগিণীর ঠিক মিল থাকে না৷
তৃতীয় কারণ, যাঁহারা উচ্চাঙ্গের কীর্তন গান করেন, তাঁহারা রাগরাগিণী অপেক্ষা প্রথাগত সুরের দিকেই বেশী মনোযোগ দেন৷ অর্থাৎ পূর্বে মহাজনদের দ্বারা গানটি কিরূপ সুরে গাওয়া হইত, তাহারই মর্যাদা তাঁহারা অধিক দেন৷ পূর্ব হইতে কতকগুলি সুর ওস্তাদ বা মহাজনকর্তৃক গীত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারই অনুকরণচেষ্টায় কীর্তনগান সার্থক হয়৷ অবশ্য ঐ সকল মহাজন রাগরাগিণীতে পারদর্শী ছিলেন এবং সেইজন্য বিভিন্ন সুরের ‘রাসায়নিক সংমিশ্রণ’ করিয়া তাঁহারা এক অপূর্ব গীতরস সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন৷ কিন্তু তাঁহাদের ন্যায় অভিজ্ঞতার অভাব-বশতঃ গীতের উত্তরাধিকারিগণ হয়তো সে সুরশিল্প আয়ত্ত বা রক্ষা করিতে পারেন নাই৷ এইজন্য কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে, কীর্তনগানের ধারা অত্যন্ত মামুলি হইয়া পড়িয়াছে৷ কিন্তু শিল্পে গতানুগতিকতা কতকটা রক্ষা না করিলে তাহার আভিজাত্য থাকে না৷ প্রাচীনের মর্যাদা রক্ষা করিয়া, শিল্পী যদি তাঁহার উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেন, তবেই তাঁহার শিল্প বা সংগীত সজীবতার দাবি করিতে পারে৷
চতুর্থ কারণ, বহুদিন হইতে কীর্তনগানের সমাদার কমিয়া গিয়াছে৷ পৃষ্টপোষকতার অভাবে বা জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহের অভাব ঘটিলে কোনও শিল্প কখনও উন্নতি লাভ করিতে পারে না ৷ বৈষ্ণব ভাবধারার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কীর্তনের প্রসার হইয়াছিল; আবার তাহার অভাবে কীর্তনেরও অবনতি অনিবার্য হইয়া উঠিল৷ এই কারণে উপযুক্ত অভিজ্ঞ গায়কমণ্ডলী কীর্তনের প্রতি সেরূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিতে বিরত হইলেন৷ বর্তমানকালেও রাগরাগিণী রীতিমত শিক্ষা করিয়া কীর্তনগান শিখিতে অগ্রসর হইয়াছেন এরূপ লোকের সংখ্যা বিরল৷ অথচ এরূপও কখন কখন দেখা যায় যে, কীর্তনের গায়ক প্রভূত অর্থবিত্তশালী হইয়াছেন এবং অন্য কোনও প্রণালী গায়কের মধ্যে সেরূপ সুসারসম্পত্তিশালী লোকের নিতান্তই অভাব৷
পঞ্চম কারণ, কীর্তনে ভগবদ্বিষয়ের সম্বন্ধ আছে বলিয়া কীর্তন-সুরের বৈশিষ্ট্য৷ বস্তুতঃ এসম্বন্ধে খুব কম সংগীত কীর্তনের সমকক্ষতা দাবি করিবার যোগ্য৷ চিত্তে আধ্যাত্মিক ভাব স্ফূরণ করিবার জন্য কীর্তনের যে কলাকৌশল সৃষ্ট হইয়াছে, তাহাকে উপেক্ষা করা চলে না৷ পূর্বে যেসকল রসের কথা বলা হইয়াছে, সেই রস সংগীতের মধ্য দিয়া ফুটাইতে হইলে এক দিকে চাই সেই সেই রসোপযোগী কথার যোজনা আর তাহার মধ্যে সেই রসোদ্দীপনকারী সুর৷ একথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, কীর্তনে যে সুরের কারুকার্য দেখা যায়৷ তাহা রসের উদ্দীপনায় সহায়তা করিবার উদ্দেশ্যেই কল্পিত৷ মনে করুন খণ্ডিতার বক্রোক্তি সুরে ফুটাইতে হইবে—
ভাল হৈল আরে বন্ধু আইলা সকালে৷
প্রভাতে দেখিলাম মুখ দিন যাবে ভালে৷
বন্ধু তোমার বলিহারি যাই৷
ফিরিয়া দাঁড়াও তোমার চাঁদ মুখ চাই৷৷
আই আই পড়েছে মুখে কাজরের শোভা৷
অধরে সিন্ধুরবিন্দু মুনির মনোলোভা৷ ইত্যাদি
চণ্ডীদাসের এই প্রসিদ্ধ গানটি করিবার সময় সুরের দ্বারা কীর্তনগায়ক যে ব্যঙ্গের অবতারণা করেন, তাহার তুলনা দেখা যায় না৷ কাজেই এখানে সুরশিল্প সেই উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত হইয়াছে৷ রাগিণীর (ভৈরব) প্রতি অত্যধিক মনোযোগ দিলে সে উদ্দেশ্যেই নিয়োজিত হইয়াছে৷ রাগিণীর (ভৈরব) প্রতি অত্যধিক মনোযোগ দিলে সে উদ্দেশ্য হয়তো সফল হইত না৷ এরূপ স্থলে রাগিণীকে প্রধান করা হয় নাই, ভাবকেই প্রধান স্থান দেওয়া হইয়াছে৷ সকলেই স্বীকার করিবেন যে, গানের সুরে ব্যঙ্গের ভাব ফুটাইয়া তোলা অত্যন্ত কঠিন৷ এখানে কীর্তনগায়ক সেই কঠিন পন্থা অবলম্বন করিয়াছেন মনে হয়৷ তবে রাগিণীর ব্যতিক্রম হয়, এরূপ কোনও চেষ্টা পরিহার করিবার দিকেই কীর্তনগায়কের লক্ষ্য থাকে৷
একটি লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, কীর্তনে ‘সম্পূর্ণ জাতি’র গানই প্রচলিত অর্থাৎ সা ঋ গম প্রভৃতি সাতটি স্বরই সব গানে ব্যবহৃত হয়৷ ঔড়ব (পঞ্চ স্বরা) ও ষাড়ব(বা খাড়ব – ষট্স্বরা) জাতির গান প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায় না৷ সম্পূর্ণ জাতির গান বলিয়াই হউক অথবা গায়ক-মহাজনদের উদ্ভাবিত সুর বলিয়াই হউক, কতকগুলি গানকে ‘জাতগান’ বা জাতি-গান বলা হয়৷ প্রাচীনপন্থী কীর্তনগায়কগণ ‘জাত সুরে’র গানই করিয়া থাকেন৷ বলা বাহুল্য, প্রাচীন কাল হইতে চলিয়া আসিতেছে বলিয়া এই সকল সুরের যে আভিজাত্য আছে, তাহা স্বীকার করিতেই হইবে৷
অভিজ্ঞ সুরশিল্পীরা এই সকল সুরের মধ্যে অনেক প্রাচীন রাগরাগিণীর সন্ধান পাইতে পারেন৷ সঙ্গীতরত্নাকর বা সঙ্গীতপারিজাত প্রভৃতি শাস্ত্রে রাগরাগিণীর যে রূপে সন্ধান আমরা পাই তাহা কালবশে অনেকস্থলে পরিবর্তিত হইয়াছে৷ সঙ্গীতজ্ঞরা গবেষণা করিলে সেই প্রাচীন রূপ হয়ত কীর্ত্তনের মধ্যে কিছু কিছু পাইতেও পারেন৷