কেবল সামাজিক উৎসব উপলক্ষে গীত সঙ্গীতগুলিকে ব্যবহারগীত বলা হয় ৷ যতগুলি উৎসব আছে, এই ব্যবহারগীত তত রকমের হয় এবং প্রত্যেকটির নিজস্ব সুর আছে ৷ এইসব গীত অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সেই কারণেই লোকমুখে বহুল প্রচারিত এ প্রসারিত, এর লিখিত রূপ কমই পাওয়া যায় ৷ সেইজন্য এই সব গানের প্রামাণ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায় ৷ প্রতিটি মৈথিল পরিবারে যে কোনো উৎসবের শুরুতে কিছু গান করা হয় যা দেবদেবীর স্তুতিসূচক ভক্তিগীতি, তা ছাড়া আছে শিবের বিবাহ সম্বন্ধে গীত যা সচরাচর বিবাহ উৎসবেই গাওয়া হয়, আর আছে কিছু ‘উচিতি’ গীত যা কন্যাপক্ষের মহিলারা বরের উদ্দেশে গেয়ে থাকেন; এগুলি বধূর সঙ্গে কোমল ব্যবহার এবং তার দোষত্রুটি ক্ষমা করার জন্য আবেদনমূলক–এগুলি ছাড়া অন্য কোনো রকম ব্যবহারগীতির বিশ্বাসযোগ্য সংকলন যা বিদ্যাপতির রচনা এবং উৎসবের জন্যই বিশেষভাবে রচিত, পাওয়া যায় না ৷ এমনকি অনেকে এমন সন্দেহও প্রকাশ করে থাকেন যে আদৌ কোনো ব্যবহারগীতি বিদ্যাপতি কখনও রচনা করেছিলেন কি না, যদিও বহু ব্যবহারগীতি বিদ্যাপতির রচনা হিসেব প্রচলিত ৷ আমি একটি এই ধরনের ব্যবহারগীতের সন্ধান পেয়েছি যা ৪০০ বছর আগে ভূর্জপত্রে লিখিত, যে ধরনের গান বিবাহ উৎসবে এখনও মিথিলায় গাওয়া হয়, অবিকল সেইরকম, এটি বরের উদ্দেশে বিবাহ তিথির একবছর কি তারও পরে বর্ষব্যাপী ভোজনের পরে গাওয়া হয় ৷ এগুলিকে ‘জোগ গীত’ বলা হয় এবং এগুলি মন্ত্রতন্ত্র বা সেইসব স্ত্রীআচার বিষয়ক যা দিয়ে নববধূ পতিকে বশীভূত করতে পারে ৷ এইসব গীতের মূল বিষয় বিদ্যাপতি এইভাবে বর্ণনা করেছেন, ”হে আমার কন্যা, এই মন্ত্র মন দিয়ে শোনা, এই মন্ত্রে এমন পন্থার কথা বলা হয়েছে যা দিয়ে তোমার (অর্থাৎ নবোঢ়ার) পতি দ্বিতীয়া (নারীর)-র প্রভাবমুক্ত থাকবে” এবং তারপর এতে জড়িবুটির শরবত প্রস্তত প্রণালী, ধূপ জ্বালানো,চোখে বিশেষ ধরনের মায়াকাজল লাগানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে নারী যা যা দিয়ে পুরুষকে বশ করতে পারে অর্থাৎ কামকলার বিভিন্ন দিক বর্ণনা করা হয়েছে ৷ রহস্যময়তার দিক থেকে বিচার করলে এটি শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথে বর্ণিত ডাকিনী-মন্ত্রগীতের মতোই ৷
দুঃখের বিষয় এই যে এই গানগুলি যতখানি প্রাধান্য পাবার কথা, তা পায়নি ৷ আংশিক কারণ হল দুষ্প্রাপ্যতা আর আংশিক কারণ হল দুষ্প্রাপ্যতা আর আংশিক কারণ হল যে পটভূমিকায় বা যে প্রাদেশিকতার মানসিকতা দিয়েই অনুভব করা সম্ভব ।যদিও এ গানগুলির কোনো সংকলন পাওয়া যায় না, তবুও উৎসবের প্রধানা গায়িকা রমণীকুলের মুখে মুখে এগুলি প্রচার হয়ে এসেছে ৷ নানা বিধিবিধান আচার আচরণ ইত্যাদি এই গানে স্থান পেয়েছে এবং সেইকারণে প্রচার পেতে পেতে এই গানগুলি নতুন প্রজন্মের দিশারীস্বরূপ ৷ এইভাবেই ব্যবহার গীতগুলি উৎসবাদিকে স্থান দিয়েছে প্রাণ দিয়েছে রমণীকণ্ঠে এবং বিস্মৃতি বা বিভ্রান্তির হাত থেকে তাদের রক্ষা করেছে ৷ সুতরাং এই গানগুলির নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রয়োজনীয়তা আছে ৷ কাব্যগত দিক দিয়ে এগুলি সরল, সহজবোধ্য, আবেগপূর্ণ ও আলঙ্কারিকতারহিত ৷ এই গানগুলি আবেগ ও অনুভূতির দিক থেকে সাধারণ ব্যক্তিকেও যেমন, অভিজাত সমাজকেও তেমনই আকর্ষণ করে, কারণ সকলের কাছেই এই উৎসবগুলির সমান মূল্য ৷ এই গীত বালকদের উপনয়নের সময় গীত হয় কারণ এই গানে বালকের দ্বিজত্বে দীক্ষিত হবার সময় তার পূর্বপুরুষের আনন্দের বর্ণনা আছে, বিবাহিতা বধূর পতিগৃহে যাত্রা করার সময় এই গান গাওয়া হয়, যা বিচ্ছেদবেদনাকে বিধুর করে তোলে (এগুলির নাম সমদাউনা গীত), এ ছাড়াও আছে পুত্র জন্মের সময় গীত (সোহার গীত) এগুলি আবার কন্যাজাতিকার ক্ষেত্রে তেমন গাওয়াই হয়না, যাতে বর্ণনা আছে আত্মীয়স্বজনের হর্ষোল্লাস, বিশেষত পুত্রের পিতার ভগ্নীরা এই গানের মধ্যে দিয়ে ভ্রাতা ও বিশেষভাবে ভ্রাতৃবধূর কাছে উপহার কামনা করে; মল্লার বা পাওস নামের বর্ষাগীত যা প্রোষিতভর্তৃকার বিরহ বর্ণনা করে, যে পতিবিরহিনী দোলনায় দুলতে দুলতে আপনমনে সময় কাটায় ইত্যাদি ৷ এইসব গানে যে অনুভূতির কথা বলা হয়েছে তা সমাজের স্তর নির্বিশেষে সকলের, এই অনুভূতি প্রত্যেকে ভাগ করে নিতে পারে ৷ প্রতিটি গানের নিজস্ব মনোমুগ্ধকর সুর আছে, আছে সরল, রসপূর্ণ মধুর শব্দ ও অভিব্যক্তি যে কারণে মহিলারা এই গানে যেন তড়িতাহত হয়ে যান ৷ সেই সময়ে এবং আজও অর্থাৎ বিদ্যাপতির কাল থেকে আজ পর্যন্ত শত শত কবি হাজার হাজার ব্যবহারগীতি রচনা করেছেন; কিন্তু প্রত্যেক গীতই বিদ্যাপতির শৈলীর অনুকরণ ৷