আমাদের দেশে সংস্কৃত কাব্যের যে ধারা সাধারণত প্রবাহিত হচ্ছিল কালক্রমে তা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। সংস্কৃতে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্যের কথা ছেড়ে দিলে ভট্টনারায়ণের বেনীসংহারেই বাংলার উল্লেযোগ্য নাটক, গোবর্ধনাচার্যের আর্যাসপ্তশতী, অভিনন্দের রামচরিত একমাত্র ঐতিহাসিক কাব্য। বাংলাদেশের কাব্যসাহিত্যের ধারা অন্যপথে প্রবাহিত হল মূলত সঙ্গীতের আমন্ত্রণ ও ধর্মশিক্ষার প্রয়োজনে। সংস্কৃত ভাষাকে অবলম্বন করে জয়দেবের গীতগোবিন্দ একাধারে ধর্ম, সঙ্গীত ও কাব্য সাহিত্যকে যুগপৎ যুগোচিত পুষ্টিপ্রদান করেছে। জয়দেবই পদকর্তাদের গুরু, তিনি যে ধারার প্রবর্তন করলেন তাই পদাবলীর ধারা। তাঁর পদাবলীর ছন্দ, বিষয়বস্তু, গঠনভঙ্গী, পদবিন্যাস, আলঙ্কারিতা ও ভাবভঙ্গীরই অনুসরণ করেছেন পরবর্তী পদকর্তারা। জয়দেবের এই মধুর কোমলকান্ত পদাবলী শ্রীকৃষ্ণের উজ্জ্বল মধুর রসের বৃন্দাবনলীলা অবলম্বনে রচিত এবং রাগ, তাল সংযোগে গেয়। গীতগোবিন্দের রাধা প্রধানত খণ্ডিতা ও মানিনী। ভনিতায় জয়দেব বলেছেন হরিস্মরণে যাদের মন সরস, বিলাসকলায় যারা কুতূহলী, তাদের হর্ষবৃ্দ্ধি ও ভক্তি সঞ্চারের জন্যই তাঁর কাব্য। গীতগোবিন্দ সহজবোধ্য সংস্কৃতে রচিত হওয়ায় আর্যাবর্তের সর্বত্রই — এমনকি দক্ষিণাপথের বহু স্থলে তার প্রচার ও সমাদর হয়েছিল। কিন্তু বাংলার মত অন্য প্রদেশের গীতিকাব্যে তা এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বাঙালী প্রেমিক জাতি, প্রেমের কবিতার বড়ই অনুরাগী। বাঙালীরা গীতগোবিন্দে প্রেমগীতির একটা চূড়ান্ত আদর্শ পেয়ে গেল এবং শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবে ও তাঁর প্রেম ধর্ম-প্রচারের ফলে গীতগোবিন্দ বৈষ্ণব জগতে এক অনন্য মর্যাদা লাভ করল, চৈতন্য দেব গীতগোবিন্দে লোকাতীত ব্যঞ্জনা সঞ্চার করলেন। বাঙালীর নিজস্ব-কীর্তন সঙ্গীতের অভাবনীয় সমুন্নতির ফলে গীতগোবিন্দের পদ কীর্তনের অঙ্গীভূত হয়ে অভিনব সুর তালে ধ্বনিত হতে শুরু করল। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে এই অখণ্ড সঙ্গীত হিল্লোল একমাত্র জয়দেবের, অন্য কারো নয়।

পরিচয়

গ্রন্থে নিজ সম্পর্কে কবি —“পদ্মাবতী চরণ চারণ চক্রবর্তী”, “কেন্দুবিল্ব—সমুদ্র সম্ভব—রোহিণীরমণ”, “পদ্মাবতী রমণ —জয়দেব কবি” (গীতগোবিন্দ ১/২, ৩/১০, ১০/১০, ১২/১১) ইত্যাদি কথাগুলো বলেছেন। তাঁর পিতামাতা হলেন ভোজদেব ও বামাদেবী অথবা রামাদেবী বা রাধাদেবী। যদিও এক্ষেত্রে সঠিক কোনও ঐতিহাসিক বিবরণী পাওয়া যায় নি, কিন্তু তবুও নানা জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে জয়দেবের জীবনী ও সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে নানা তথ্য আমরা জানতে পারি। তাঁর জন্মস্থান “কেন্দুবিল্ব” গ্রামটিকে বীরভূম অঞ্চল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও এনিয়ে মতান্তর রয়েছে। কিন্তু বীরভূমের অজয় নদীর তীরে কেঁদুলি গ্রামে জয়দেবের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজও মেলা বসে এবং বৈষ্ণব – ভক্ত – বাউলগণ সেখানে উপস্থিত হন। কেঁদুলিই কী কেন্দুবিল্ব ? আসলে মেলাস্থান থেকে সাতক্রোশ দূরে কেঁদুলিই হল কেন্দুবিল্ব। গীতগোবিন্দের নানা টীকায় কবিকে মিথিলা, গুজরাট কিম্বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলে দাবী করা হয়েছে। সেই অনুসারে পুরীর কেন্দুলি অথবা মিথিলার কেন্দোলি গ্রাম তাঁর জন্মস্থান রূপে চিহ্নিত। তবে বর্তমানে প্রাপ্ত নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে জন্মস্থান হিসেবে বীরভূমকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

চন্দ্রদত্তের ভক্তমালা গ্রন্থ এবং প্রসিদ্ধ টীকাকারদের টীকায় জয়দেব ও তাঁর পত্নী পদ্মাবতী সম্পর্কে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত। হলায়ুধ মিশ্রের “সেকশুভোদয়ার” কাহিনী অনুসারে জয়দেব ও তাঁর পদ্মাবতী উভয়েই মার্গসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। এক দক্ষিণী ব্রাহ্মণ দম্পতি তাঁদের কন্যা পদ্মাবতীকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে মানত করে প্রাপ্ত হন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিতামাতা সুন্দরী কিশোরীকে জগন্নাথ দেবের কাছে দেবদাসী রূপে উৎসর্গ করেন, পুনরায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁরা পদ্মাবতীকে কেন্দুবিল্ব নিবাসী জয়দেব গোস্বামীর সঙ্গে বিবাহ দেন। কথিত আছে, জয়দেব গীতগোবিন্দের পদ গাইতেন এবং পদ্মাবতী নাচতেন। বঙ্গদেশে প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী ভক্তকবি জয়দেবের অনুপস্থিতিতে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণই তাঁর রূপ ধারণ করে বহু শ্লোকের রচনা করেছেন। কোথায় যেন তাই অপূর্ব অমৃতময় জয়দেব শ্লোক অতিন্দ্রীয় তন্ময়তার স্পর্শে অনাবিল রূপে ভাস্বর হয়ে ওঠে।

গীতগোবিন্দে জয়দেব তাঁর সমসাময়িক উমাপতিধর, শরণ, আচার্য গোবর্ধন এবং কবিরাজের বিশেষ প্রশংসা করেছেনঃ-

গোবর্ধনশ্চ শরণো / জয়দেব উমাপতিঃ ।
কবিরাজশ্চ রত্নানি / পঞ্চৈতে লক্ষ্মণস্য চ ।।

এই কবিরা সকলেই সম্ভবত লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন। টীকাকার রাণাকুম্ভের মতে, “ষট পণ্ডিতা রাজ্ঞো লক্ষ্মণসেনস্য প্রসিদ্ধা ইতি”। নরনারায়ণের সভাকবি শুক্লধ্বজ বলেছেন — “লক্ষ্মণসেনসভাসদাং স্বরূপকথনেন নিজোৎকর্ষপ্রতিপাদনেন” জীব গোস্বামী ভাগবতের বৈষ্ণবতোষিণী টীকায় লিখেছেন —“শ্রীজয়দেবসহচরেণ মহারাজ-লক্ষ্মণসেন-মন্ত্রিবরেণ উমাপতিধরেণ।”

১২০৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত শ্রীধর দাসের সদুক্তি কর্ণামৃত নামক কোশকাব্যে জয়দেবের নামে একত্রিশটি শ্লোক সঙ্কলিত, তার মধ্যে পাঁচটি শ্লোক গীতগোবিন্দে পাওয়া যায়। জয়দেব মূলত বিবিধ বিষয়গুলি নিয়ে শ্লোক রচনা করেছেন যেমন কল্কি অবতার শ্রুতি, বীররসের উৎসাহ ও উদ্দীপনা, আদি-রসের কবিতা, রাজকীর্তি ও স্তুতি প্রভৃতি। রাজার স্তুতি কবিতাটি সম্ভবত মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের বন্দনা বলে মনে হয় —

“লক্ষ্মীকেলিভুজঙ্গ জঙ্গমহরে সঙ্কল্পকল্পদ্রুম
শ্রেয়ঃ সাধকসঙ্গ সঙ্গরকলাগাঙ্গেয় বঙ্গপ্রিয়।
গৌড়েন্দ্র প্রতিরাজনায়ক সভালঙ্কার-কর্ণার্পিত
প্রত্যর্থিক্ষতিপাল পালক সতাং দৃষ্টো’সি তুষ্টা বয়ম্ ”।
( সদুক্তিকর্নামৃত (Sures Chandra Banerji ) ৩।১৪২৫, পৃ.৩৮৫)

শিখদের ধর্মপুস্তক গ্রন্থসাহেবে (১৬ শতাব্দী) জয়দেবের যে দুটি শ্লোক বিকৃতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর শুদ্ধ পাঠোদ্ধার করেছেন (সাহিত্য একাদেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ জয়দেব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়)। নাভাজী দাসের ভক্তমাল গ্রন্থে (১৬০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দ) জয়দেবের বাক্য ও কবিত্ব প্রশংসিত হয়েছে এমনি ভাবে —

প্রচুর ভয়ো তিহুঁ লোক গীতগোবিন্দ উজাগর ।
কোক কাব্য নবরস-সরস-শৃঙ্গার কো আগার ।।
— সন্ত–সরোরুহ-খণ্ড কৌ পদুমাবতি-সুখজনক — রবি ।
জয়দেব কবি নৃপচক্কবৈ খণ্ড–মণ্ডলেশ্বর আনি কবি ।

রূপ গোস্বামীর লেখনীতেও লক্ষ্মণ সেনের নামে সংকলিত দুটি শ্লোকের অনুকরণ লক্ষণীয় — “রাধা মাধববয়োর্জয়ন্তি মধুরস্মেরালসসদৃষ্টয়ঃ”(১/১)। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায় জয়দেব রাজা লক্ষ্মণ সেনের শুধু সভাকবি নন, প্রিয় পাত্রও ছিলেন। অবশ্য তিনি কখন এবং কীভাবে রাজসভায় স্থানলাভ করেন তার কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।

গীতগোবিন্দ

বিষয়

সাধারণ দৃষ্টিতে গীতগোবিন্দ রাধাকৃষ্ণের প্রণয় কাহিনী অবলম্বনে সর্গবদ্ধ মহাকাব্য, কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্যের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। পশ্চিমী সমালোচকগণ একে “Pastoral drama”, “Lyric drama”, “Melodrama”, “Opera”, “Refined yatra” ইত্যাদি অভিধাতে ভূষিত করলেও কবি-স্বয়ং তাঁর কাব্যকে “পদাবলী”, “প্রবন্ধ”, “মঙ্গল-উজ্জলগীতি” প্রভৃতি আখ্যা দিয়েছেন — “করোতি জয়দেবকবিঃ প্রবন্ধম্ (১/২), মঙ্গলমুজ্জ্বল গীতিম্ (১/২৫), মধুর কোমল-কান্ত — পদাবলীম্ (১/৩)”। সংস্কৃত মহাকাব্য ধারার অন্তিম লগ্নে এবং নব্যভারতীয় সাহিত্যের উদ্ভবকালে সমালোচকগণ একে নাট্যপ্রবন্ধ, গীতিকাব্য ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন (“গীতগোবিন্দকে নাট্যপ্রবন্ধ বলতে পারি, এখনকার পরিভাষায় গীতিনাট্যও বলা চলে” — সুকুমার সেন, ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ – ৩৩৬)

কবিরাজ জয়দেবের মধুর-কোমল-কান্ত পদাবলীর প্রেক্ষাপট যমুনার তীরের বৃন্দাবন, যেখানে মধুময় বসন্ত মাস উপস্থিত হয়েছে তমাল মুকুলের অনাবিল সুগন্ধ উচ্ছাসে, যার কাছে পরাজিত হয় মৃগনাভির মাদকতা। সুগন্ধ মালয় মুখরিত কোকিল কূজন ও মধুকরের গুঞ্জনে। সেইসঙ্গে প্রোষিত ভর্তিৃকাদের অন্তর্বিলাপ বন-উপবনে ছড়িয়ে পড়েছে করুণ রাগিনীর মত। শ্যামল ছায়ায় আচ্ছাদিত যমুনা পুলিনের মানুষ মানুষী, রাগ-অনুরাগ, মিলন বিরহ বর্ণনাই তাই গীতগোবিন্দের মুখ্য উপজীব্য বিষয়।

সমগ্র কাব্যটি বারোটি সর্গে বিভক্ত এবং বারোটি সর্গই নানা আলঙ্কারিক অভিধায় বর্ণময়। প্রথম সর্গে প্রেমাকুল রাধা কৃষ্ণের সন্ধানে নিবিষ্টা, প্রিয়সঙ্গের বহু স্মৃতিতে তাঁর অন্তরে মেদুর কিন্তু প্রেমিক কৃষ্ণ তখন অন্য বহু ব্রজনারীদের সঙ্গে সম্ভোগ বিলাসে মত্ত – তাই এই অংশের নাম “সামোদ-দামোদর”। দ্বিতীয় সর্গে সখীদের মুখে অন্য নায়িকাদের প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগের কথা শুনে রাধিকার চিত্ত ভারাক্রান্ত কিন্তু তবুও দয়িতের সঙ্গে পূর্ব মিলনের স্মৃতিগুলি তিনি রোমন্থন করেন। সখীগণের প্রার্থনা কৃষ্ণ যেন তাঁর সর্বাধিক প্রিয় দয়িতের কাছে পুনরায় ফিরে আসেন, তাতে দূর হবে সকল ক্লেশ ও দুর্দশা, তাই এই সর্গ “অক্লেশ-কেশব”। তৃ্তীয় সর্গে উৎকন্ঠিতা প্রেমাকুল রাধার কথা স্মরণ করে কৃষ্ণচিত্তও ব্যাকুল, তাই তিনি “মুগ্ধ মধুসূদন”। চতুর্থ সর্গে রাধার সখীর নিকট কৃষ্ণ সংবাদ পান অভিমানিনী প্রিয়া তাঁর পরনারী সংসর্গ সংবাদে অন্তর্দাহে দাহ্যমান-এ সংবাদ কৃষ্ণ হৃদয়কে আত্মতৃপ্তিতে স্নিগ্ধ করে, তাই এই সর্গ “স্নিগ্ধ মধুসূদন”। অনুতপ্ত কৃষ্ণ রাধার সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খার কথা জানালেন দূতীকে। দূতী রাধাকে অভিসারযোগ্য নীচোল পরে আলিঙ্গন-চুম্বন ও বিপরীত রতি বিহারের আশায় উদ্বুদ্ধ করলেন। তাই পঞ্চম সর্গে কৃষ্ণ হলেন “সাকাঙ্ক্ষ পুণ্ডরীক”। ষষ্ঠ সর্গে-বিরহিনী রাধা নিজেই নিজেকে কৃষ্ণ কল্পনা করে বিভোর, আত্মানন্দে তন্ময় এবং বিপরীত রতিতে চতুর কৃষ্ণ দয়িতার লীলা সঙ্গে উৎসুক তাই এখানে তিনি “ধৃষ্ট বৈকুন্ঠ”। সপ্তম সর্গে প্রিয় আগমনের আশায় উন্মুখ রাধা সখীকে একাকিনী ফিরতে দেখে দুঃখে মুহ্যমান। মধু বসন্ত জাগরীতে অন্য নারীদের সঙ্গে রতি বিলাসে মগ্ন প্রেমিকের চিত্র কল্পনা করে তিনি ক্ষুব্ধ, ঈর্ষান্বিতা – এই অংশে নায়ক “নাগর নারায়ণ”। প্রেম-সম্ভোগে সুপটু কৃষ্ণের দেহে অন্য নারী অঙ্কিত সম্ভোগ চিহ্ন দেখে রাধা যথাক্রমে লজ্জিতা ও ক্ষুব্ধ – তাই অষ্টম সর্গ “বিলক্ষ লক্ষ্মীপতি”। অভিমানিনী রাধা কৃষ্ণকে প্রত্যাখান করলেন কিন্তু অন্তরের ব্যাকুলতা তাতে গোপন হল না, সখীরা রাধাকে তীব্র ভৎর্সনায় জর্জরিত করলেন, অবশেষে দূতী রাধার প্রেম ও অনুতাপ নিবেদন করল কৃষ্ণকে তাই নবম সর্গে তিনি “মুগ্ধ মুকুন্দ”। দশম সর্গে বিনোদিনী রাধার মানভঞ্জনে নিয়োজিত কৃষ্ণ যখন মুগ্ধ তখন অনুতপ্তা রাধাও বিহ্বল, তাই সর্গের নাম “মুগ্ধ মাধব”। একাদশ সর্গে কৃষ্ণ মিনতিতে রাধার সকল মান-অভিমান বিস্মৃত, সখীদের আশ্বাসে মিলন পিয়াসী রাধা কুঞ্জ গৃহে এলেন, নায়ক তখন আনন্দে অধীর। তাই এই সর্গের নাম “সানন্দ গোবিন্দ”। দ্বাদশ সর্গে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটল পারস্পরিক চুম্বন, আলিঙ্গন ও মধুর বচনে, তাই অন্তিম সর্গ “সুপ্রীত পীতাম্বর”।

বিশ্লেষণ

গীতগোবিন্দের আলোচনায় কাব্যের তিনটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় – প্রথমত প্রণয়কাব্যের পরিমণ্ডল, দ্বিতীয়ত অলৌকিক ভাগবত প্রেমতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত নাট্যগান। সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাস থেকে শৃঙ্গার বর্ণনার যে ধারার সূত্রপাত হয়েছিল যা কিনা মহাকাব্য-খণ্ডকাব্য, প্রকীর্ণ কবিতাসহ দেব-দেবীর লীলাবিহার বর্ণনা সবখানেই একই আঙ্গিক ও উপাদানে পরিপুষ্ট ছিল সেই ধারাই জয়দেব গীতগোবিন্দে অনুসরণ করেছেন। শুধু জয়দেব নন বরং বলা যায় তাঁর সমসাময়িক উমাপতি ধর, শরণ, গোবর্ধন আচার্য, ধোয়ী প্রভৃতি কবিগণও প্রণয় কবিতা রচনায় সেই আঙ্গিকের বশবর্তী হয়েছেন। এক্ষেত্রে এমন শৃঙ্গার রস বৌদ্ধিক মহলে “চটুল” বলেই চিহ্নিত। ধোয়ীর পবনদূত, গোবর্ধনের আর্যাসপ্তশতী কিংবা কোশকাব্যে সঙ্কলিত সে যুগের শৃঙ্গার সর্বস্বতা অনুধাবন করতে গেলে তৎকালীন বাংলার রাজকীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলটিকে বুঝতে হবে। উক্ত সকল কবিরই সময়চিত্রটি এক – সেনযুগ, বিশেষত লক্ষ্মণ সেনের যুগ (১১৭৯-১২০৭ খ্রিস্টাব্দ)।

আরবগণ সিন্ধু বিজয় করেন ৭১২ খ্রিস্টাব্দে। সিন্ধুতে তাদের স্থায়ী রাজ্যের স্থাপনা না হলেও মুসলিম আগমন বার্তাটি সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। এর পরবর্তী পর্যায়ে ধাপে ধাপে নানা সময়ে গোটা ভারতবর্ষেই তাদের পদচারণা বলিষ্ঠ হতে থাকে। এইসময় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পদ ও দারিদ্র দুটি পাশাপাশি থাকলেও সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে কোনও সংহতি ছিল না, ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বদেশের প্রতি অনুরাগ ছিল না, কোনও কেন্দ্রীয় শাসন না থাকায় আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা বড় বেশি করে প্রকটিত হয়। প্রতি অঞ্চল নিজেকে অপর অঞ্চল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত। সমাজে ধন বন্টন ছিল না, খেটে খাওয়া মানুষরা ছিল অবহেলিত ও নির্যাতিত। সামাজিক ন্যায়-বিচার না থাকায় সাধারণ মানুষও হতাশাগ্রস্ত, তার আভাষ পাওয়া যায়। রাজারা প্রজাদের দুঃখ নিরূপণের জন্য কোনোরূপ বিধিসঙ্গত প্রচেষ্টা করেননি। সাধারণ শ্রমিক, ভূমিহীন শ্রমিকরা বেশ দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাত। পাল যুগে বিভিন্ন ধর্মমতের প্রতি যে সহনশীল মনোভাব দেখা যেত সেই সমন্বয়বাদ কিন্তু সেন যুগে ছিল না। বিশুদ্ধ বৈদিক আচারের তাগিদে সেন রাজারা নতুন করে জাতি বিভাজন করেন। মধ্যযুগের ইউরোপে গীর্জাগুলি যেমন জনগণের জীবনকে কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধত, সেন রাজারা তেমনি আচার-পদ্ধতি, বিবাহ সম্পর্ক রীতি, জাতি বিভাগ করে হিন্দু সমাজকে কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধবার আয়োজন করেন। সমাজের সমন্বয় ও রাজাদের প্রতি জনগণের ভালোবাসা ও বিশ্বাস তার ফলে নষ্ট হয়েছিল কুলীন, ভঙ্গ ও অভঙ্গ কুলীন, রাঢ়ী, বৈদিক, বারেন্দ্র প্রভৃতি অসংখ্য কুলে ব্রাহ্মণরা যেমন বিভক্ত হন তেমন অব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রেও নানা ভাগ করা হয়। অনুগত ব্রাহ্মণদের সাহায্যে পুঁথি লিখিয়ে ইচ্ছামতো বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি বর্ণনা করা হয় এবং স্বেচ্ছাচারীভাবে কাউকে উচ্চ, কাউকে নীচ বলে ঘোষণা করা হয়। সমাজে জাত-পাতের বিভেদটাই বড় হয়ে ওঠে। সংহতি ও ঐক্য ধ্বংস হয়। এর আড়ালে গড়ে ওঠে একটি তথাকথিত উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী যারা সমাজের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার একচেটিয়া ভাগীদার হয়। নগর পুড়লে দেবালয়ও যেমন আগুন থেকে মুক্তি পায় না তেমনি সমাজের যন্ত্রণা ও ক্লিষ্টতার ছাপ সাহিত্যেও পড়েছিল। বাঙালীর ইতিহাসে নীহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য “…….যেখানেই লক্ষ্মণ সেন, সেখানেই ‘কেলি’ তাহা রাজকীয় লিপিতেই হোক বা কবির স্তুতিতেই হোক। এ তথ্যের ইঙ্গিত অবহেলার বস্তু নয়”। (নীহাররঞ্জন রায় – বাঙালীর ইতিহাস, পৃঃ ৭৭৫)। এমন তথ্য সত্যতা বহন করে। আসলে যেখানে পরিবেশগতভাবে মানব মন সদা বিক্ষিপ্ত সেখানে সে প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণের দ্বারা একটু প্রশান্তি খুঁজছে। তাই আপামর সমাজের অন্তর প্রেমের সার্বিক চিত্রটিই তৎকালীন সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে ফুটে উঠেছে। পুরাণ প্রসিদ্ধ গোপীকৃষ্ণ – প্রেমলীলার পাশাপাশি আদি রসাত্মক লৌকিক প্রেম ধারাটিই জয়দেবের দ্বারা কাব্যরূপে প্রকাশিত হয়, এক্ষেত্রে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সংস্কৃত কবিদের নিকট ঋণী। জয়দেব গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের পূর্বসূরি — এইমত বিচারসাপেক্ষ, অনেকের অনুমান ধর্মমতে তিনি ছিলেন পঞ্চোপাসক স্মার্ত। তৎকালীন যুগমানসের প্রচলিত ধারণাই কবির লেখনীতে উদ্ভাসিত হয়েছে ললিত কাব্য হিসেবে।

শুধু সাহিত্য নয়, সঙ্গীতেও গীতিগোবিন্দকে অনন্যতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই কাব্যের বারোটি সর্গে মোট চব্বিশটি অষ্টপদী গান ও অষ্টপদীর পূর্বে একটি সম্মিলিত সঙ্গীত বা Chorus আছে। গানগুলি মালব, গুর্জরী, রামকিরী প্রভৃতি রাগে এবং রূপক, নিঃসার প্রভৃতি তালে নিবদ্ধ। বর্ণনা প্রধান শ্লোকগুলি প্রধানত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত, কিন্তু ২৪টি গান মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। সঙ্গীতবিদদের মতে এগুলি “প্রবন্ধ গান”। উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের (আনুমানিক ১৬০০ শতক) আদেশে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গীতগোবিন্দ গীত হত। তবে গ্রন্থে উল্লিখিত রাগগুলি সম্পর্কে সঙ্গীতজ্ঞদের মনে সন্দেহ আছে। টীকাকার রাণাকুম্ভ বলেছেন যে, তিনি স্বয়ং রাগগুলির দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দিয়েছেন। দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তিমার্গানুসারে সঙ্গীতসাধকগণও দক্ষিণ সঙ্গীতের রাগমার্গে উক্তগানগুলি নিবদ্ধ করেছেন। বাংলার কীর্তন গানের গায়কীতেও এর প্রভাব পড়েছে। গীতগোবিন্দের গায়কী সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে অনুমান করা যায়, গানগুলির গায়ন পদ্ধতিতে মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে লোকসঙ্গীতের সুরও কিছুটা মিশেছিল।

গীতগোবিন্দের অনুকরণে পরবর্তীকালে বেশ কিছু গীতিকাব্য রচিত হয়েছিল। এইসব রচনার পশ্চাতে ধর্মীয় অনুপ্রেরণাই ছিল প্রধান। গীত গোবিন্দানুসারী কাব্যগুলি হল — বংশমুনির পীতাম্বর, ভানুদত্তের গীত গৌরীপতি, সোমনাথের কৃষ্ণগীত, হরিশঙ্কর, প্রভাকর ও রামকবির গীত রাঘব নামক তিনটি পৃথক কাব্য, রামের গীতগিরিশ, তিরুমলরাজের গীতগৌরী। গীতগৌরী হুবহু জয়দেবের কাব্য অনুকরণে রচিত, বিষয় মহাদেব গৌরী প্রণয় । এছাড়াও উড়িষ্যার রাজা পুরুষোত্তম দেব (১৪৭৩ – ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দ) গীতগোবিন্দের অনুসরণে অভিনব-গীতগোবিন্দ রচনা করেন। বল্লভাচার্যের অনুগামী বৈষ্ণব সম্প্রদায় যে তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে জয়দেবের কাব্য ব্যাখ্যা করেন, তারই ধারা অনুসরণ করে বল্লভপুত্র বিঠঠলেশ্বর শৃঙ্গার – রসমণ্ডল কাব্য রচনা করেন।

গীতগোবিন্দে যে যাত্রাগানের পূর্ণরূপ পাওয়া গেছে তার আদি ও অন্ত বিলুপ্ত হলেও এই ধরণের যাত্রা গান যে ধর্মীয় উৎসব – অনুষ্ঠান ও পালাপার্বণে গাওয়া হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় বৃহদ্ধর্ম পুরাণের কাহিনীতে – যেখানে দেবসভায় শিব গান ধরেছেন – গানের বিষয় রাধাকৃষ্ণের প্রেম। কৃষ্ণের কাছে রাধার সঙ্কেত নিয়ে উপস্থিত দূতী কৃষ্ণকে বলেছেন –

কেশব কমলমুখীমুখকমলম্
কমলনয়ন কলয়াতুলমমলম্ ।
কুন্জগেহে বিজনে’তিবিমলম্ ।।

কিছুক্ষন পরে শিব পুনরায় গান গেয়ে রাধার কথা কৃষ্ণকে বলেছেন —

রসিকেশ কেশব হে
রসসরসীমিব মামুপযোজয়
রসময় রসনিবহে ।।

জয়দেবের বহু পূর্বেই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলগুলির মত বাংলাদেশেও আধ্যাত্মভাবনাকেন্দ্রিক গোপী – কৃষ্ণ প্রণয় কাহিনী সার্বজনীনভাবে সমাজের সর্বস্তরে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল। পন্ডিতদের অনুমান খ্রিস্টীয় প্রথম শতক বা তার কিছু পূর্ব থেকেই মহাভারত প্রসিদ্ধ বিদগ্ধ জ্ঞানী কৃষ্ণ অপেক্ষা গোপবালক কৃষ্ণর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ ও ভাগবত পুরাণে গোপীকৃষ্ণলীলার অসংখ্য কাহিনী থাকলেও সেখানে রাধার উল্লেখ নেই। মৎস, পদ্ম, বরাহ, বায়ু ও ব্রহ্মাবৈবর্ত পুরাণে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার বিশদ বর্ণনা থাকলেও নিঃসন্দেহে বলা যায় এগুলি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের রচনা। ব্রহ্মবৈবর্তে রাধার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত এবং সেই ধারাই জয়দেব সহ বাঙালী বৈষ্ণব কবিদের রচনায় অনুসৃত সংস্কৃত সাহিত্যে প্রথম হালের গাথা সপ্তশতীতে (আনুমানিক খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় – তৃতীয় শতক) রাধার উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার নাটকে (খ্রিস্টিয় অষ্টম শতক), আনন্দবর্ধনের ধ্বন্যালোকে (খ্রিস্টিয় নবম শতক) ও কবীন্দ্রবচন সমুচ্চয়ে সঙ্কলিত বাঙালী কবিদের কবিতায় কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা ও অন্যান্য গোপীদের প্রণয় বিষয়ে অনেকগুলি শ্লোক উপলব্ধ। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় থেকে একাদশ – দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এরূপ অনেক প্রকীর্ণ কবিতা পাওয়া গেলেও রাধাকে নায়িকা করে জয়দেবই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃত প্রেম কাব্য রচনা করেন।