শাওন ঘন নিশীথ আঁধারে একাকিনী নারী চলেছে কুঞ্জাভিসারে। বিদ্যুৎ চমকায় ঘন ঘন। চোখে কাজল, পরনে নীল শাড়ি। নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলে সে কিশোরী। অস্ফুট মনের কোনে উচ্চারিত হয়- ‘ রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেওয়া গরজন’।
আজকের আধুনিক মনে সেই সুদূর মধ্যযুগের কোন এক তড়িৎ চমকিত, শাওন নিবিড় রাতের উন্মুখ হৃদয়ের মেয়েটি চির নবীন। কালের স্পর্শ বাঁচিয়ে তাকে চির নতুন করে রেখেছেন যে কবি, তাঁর নাম জ্ঞানদাস। তাঁর পদ আমাদের যতটা হৃদয়ের কাছাকাছি, তিনি ততটাই কুয়াশাবৃত্ত। কিন্তু আমাদের দুর্নিবার কৌতুহলী মন কেবল রসনাস্বাদন করেই ক্ষান্ত হয় না, সে উৎসটিকেও খুঁজে পেতে চায়। তাইতো এখনও জ্ঞানদাসকে জানার, চেনার চেষ্টার অন্ত নেই।
জ্ঞানদাসের জন্মপরিচয় অণ্বেষণ
মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদসাহিত্যের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কবি চতুঃষ্টয় হলেন চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাস। চণ্ডীদাসকে নিয়ে তো অন্তহীন সমস্যা; বিদ্যাপতির জীবনকথা কিছু কিছু জানা যায়; গোবিন্দদাসের জীবন মোটামুটি পরিচিত; কিন্তু জ্ঞানদাস সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানা যায় না। ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা নানা উপকরণই আমাদের ভরসা। সেইসকল জানা-অজানা উপকরণের সাহায্যে জ্ঞানদাসকে জানার চেষ্টা করব। জ্ঞানদাসের জন্মকাল, বাসস্থান ও জীবনকথার মধ্যে নানা কল্পকাহিনী, কিংবা লোককথা বা জনশ্রুতি মিলে থাকলেও দু- একটি বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থে আছে –
রাঢ়দেশে কান্দরা নামেতে গ্রাম হয়।
যথায় মঙ্গল জ্ঞানদাসের আলয়।।
আবার নরহরি চক্রবর্তীর ‘গৌরপদতরঙ্গিণী’র নরহরি দাস ভনিতাযুক্ত একটি পদে রয়েছে জ্ঞানদাসের বন্দনা –
শ্রীবীরভূমেতে ধাম কাঁদড়া মাঁদড়া গ্রাম
তথায় জন্মিলা জ্ঞানদাস।
আকুমার বৈরাগ্যেতে রত বাল্যকাল হৈতে
দীক্ষা লৈলা জাহ্নবার পাশ।।
অদ্যাপি কাঁদড়া গ্রামে জ্ঞানদাস কবি নামে
পূর্ণিমায় হয় মহামেলা
তিনদিন মহোৎসব আসেন মহান্ত সব
হয় তাহাদের লীলাখেলা।।
‘মদন মঙ্গল’ নাম রূপে গুণে অনুপাম
আর এক উপাধি মনোহর।
খেতুরীর মহোৎসবে জ্ঞানদাস গেলা যবে
বাবা আউল ছিল সহচর।।
কবিকুলে যেন রবি চণ্ডীদাস তুল্য কবি
জ্ঞানদাস বিদিত ভুবনে
যার পদ সুয্যসার যেন অমৃতের ধার
নরহরি দাস ইহা ভনে।।
এবিষয়ে কোন গোলযোগ নেই যে জ্ঞানদাসের জন্ম কাঁদড়া বা কান্দরা গ্রামে। তবে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে। ‘মঙ্গল’ কি জ্ঞানদাসের উপাধি নাকি বিশেষণ অথবা অন্য কোন ব্যক্তির নাম? পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘মঙ্গল’ পৃথক ব্যক্তি। এই মঙ্গল ঠাকুর ছিলেন শ্রীচৈতন্যের অন্তরঙ্গ পার্ষদ পণ্ডিত গদাধরের শিষ্য। গদাধর শাখার গণনায় এঁর নাম আছে- ‘যদু গাঙ্গুলি আর মঙ্গল বৈষ্ণব।’ এঁর মুর্শিদাবাদের কিরীটীকোনা গ্রামে জন্ম হলেও শৈশবে পিতা মাতা কে হারিয়ে নানা স্থানে ঘুরে চলে আসেন কাঁদড়ায়। সেখানেই গড়ে তোলেন বাসস্থান। এখন তাঁর বংশধরেরা সেখানেই বাস করে। জ্ঞানদাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল এবং উভয়েই খেতুরির মহোৎসবে উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং মঙ্গল বৈষ্ণব ও জ্ঞানদাস সমসাময়িক ও একই গ্রামে বাস করতেন। অবশ্য কেউ কেউ মনে করতেন জ্ঞানদাস মঙ্গলবংশীয় রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিত্যানন্দ- শাখা বর্ণনায় জ্ঞানদাসের নামোল্লেখ করেছেন-
পীতাম্বর মাধবাচার্য দাস দামোদর।
শঙ্কর মুকুন্দ জ্ঞানদাস মনোহর।।
কিন্তু এ তথ্য তাঁর পরিচয় হিসেবে যথেষ্ট নয় এবং এখানে উল্লেখিত জ্ঞানদাস, আসলে কবি জ্ঞানদাস কিনা তাও বোঝা যায় না। অবশ্য একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ জয়ানন্দ গৌরিদাস পণ্ডিতের ‘কবিত্ব সুশ্রেণীর’ কিংবা পরমানন্দগুপ্তের ‘গৌরঙ্গবিজয়’ গীতের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এদের নাম নিত্যানন্দ শ্রেণীতে উল্লেখের সময় কবিত্বের বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন। রামানন্দ বসু বা কানুঠাকুরের ক্ষেত্রেও ‘কবি’ শব্দের উল্লেখ নেই। অতএব ‘কবি’ শব্দ ব্যবহার না হলেও ইনিই জ্ঞানদাস; যিনি নিত্যানন্দের ভক্ত ছিলেন। তিনি নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবীদেবীর থেকে দীক্ষামন্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। ‘গৌরপদতরঙ্গিণী’র পদটিও কৃষ্ণদাস কবিরাজের কথাকেই সমর্থন করে যে জ্ঞানদাসকে দীক্ষা জাহ্নবীদেবীই দিয়েছিলেন। কিন্তু নিত্যানন্দের শাখায় এমন আনেকের নাম আছে, যারা নিত্যানন্দের শিষ্য ছিলেন না। গোবিন্দ, মাধব ও বাসু ঘোষ প্রমুখের নাম চৈতন্য ও নিত্যানন্দ উভয় শাখাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু উভয়ের থেকেই তাঁরা দীক্ষা নিয়েছেন এমনটা নিশ্চই সম্ভব নয়। কাঁদড়ার এক প্রবাদ শুনে পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় জ্ঞানদাসকে বিবাহিত বলেছেন। তাঁর নাকি এক পুত্র ছিল। অবশ্য এই পদে জ্ঞানদাস চিরকুমার। ‘আকুমার বৈরাগ্যতে’ বলা হয়েছে। বিমানবিহারী মজুমদার এই পদের প্রমাণিকতার ভিত্তিতে জ্ঞানদাসকে চিরকুমার বলে মেনে নিয়েছেন। পদে যে মেলার উল্লেখ আছে তা এখনও প্রচলিত। কাঁদড়ায় জ্ঞানদাসের মঠে পৌষমাসের পূর্ণিমায় তিনদিনব্যাপী উৎসবে জ্ঞানদাসকে স্মরণ করা হয়। শ্রদ্ধেয় অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য নরহরিদাসের পদটিকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন। তাঁর মতে পদটি নরহরি চক্রবর্ত্তীর(ঘনশ্যাম) ‘ভক্তিরত্নাকরে’ নেই এবং নরহরি সরকার জ্ঞানদাসের পূর্ববর্তী। কিন্তু পদটিতে প্রদত্ত অধিকাংশ তথ্য আজও সত্য। পদে যে আউলিয়ার উল্লেখ আছে তিনি হলেন প্রসিদ্ধ ভক্ত মনোহর দাস আউলিয়া। জ্ঞানদাসের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। জ্ঞানদাস পূজিত শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ বিগ্রহে ভার তাঁর মৃতুর পর গ্রহণ করেন এই মনোহর দাস আউলিয়া। বিতর্ক যতই থাক একটি বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত যে জ্ঞানদাসের জন্ম বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অধীন কাঁদড়া গ্রামে। দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘সিউড়ির বিশক্রোশ পূর্বে ও বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাটোয়ার দশ মাইল পশ্চিমে কাঁদড়া গ্রাম’। আমেদপুর – কাটোয়া রেললাইনে রামজীবনপুর ষ্টেশনের কাছেই কাঁদড়া অবস্থিত।
জ্ঞানদাসের সময়কাল অন্বেষণ
জ্ঞানদাসের জন্মসন সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। ক্ষীরোদচন্দ্র রায়ের মতে জ্ঞানদাসের জন্ম হয় ১৪৫৭ শকে অর্থাৎ ১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দ। হারাধন দত্ত, জগদ্বন্ধু ভদ্র, দীনেশচন্দ্র দাসের মতে জ্ঞানদাসের জন্মসাল যথাক্রমে ১৫৩৭, ১৫৩১ এবং ১৫৩০ খ্রীষ্টাব্দ। কিন্তু এই সন তারিখ যাচাই করে নেওয়ার মতো কোন উপাদান পাওয়া যায় না। এই সন তারিখ অনেকাংশেই অনুমান নির্ভর।
‘ভক্তিরত্নাকর’ ও ‘নরোত্তমবিলাস’ গ্রন্থদ্বয়ে কাটোয়া ও খেতুরীর মহোৎসব বর্ণনার প্রসঙ্গে জ্ঞানদাসের নামোল্লেখ রয়েছে। যদুনন্দন চক্রবর্তীর উদ্যোগ তৎকালীন কটকনগর অর্থাৎ কাটোয়ায় মহোৎসবের আয়োজন হয়েছিল। গুরু গদাধর দাসের তিরোভাব উপলক্ষে কার্তিকের কৃষ্ণাষ্টমীতে এই উৎসব হয়। এখানে ৬৪ জন নেতৃস্থানীয় বৈষ্ণব উপস্থিত হন। তাঁদের নাম উল্লেখ আছে ‘ভক্তিরত্নাকেরর’ নবম তরঙ্গে। সেখানে জ্ঞানদাসের নাম আছে-
শ্রী মাধবাচার্য রাম সেন দামোদর।
জ্ঞানদাস নর্তক গোপাল পীতাম্বর।।
‘নরোত্তমবিলাস’- এর তথ্য অনুযায়ী নরোত্তম ঠাকুরের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি খেতুরীর মহোৎসবে যোগদানের জন্য নিমন্ত্রণ করতে খড়দহে আসেন, তখন সেখানে জ্ঞানদাস উপস্থিত ছিলেন। আবার ষষ্ঠ বিলাসে কবি লিখেছেন-
শ্রীল রঘুপতি উপাধ্যায় মহাবীর।
মুরারি-চৈতন্য জ্ঞানদাস মনোহর।।
কথিত আছে জ্ঞানদাস রূপবান ছিলেন। এখানে ‘মনোহর’ শব্দে কি তারই ইঙ্গিত? আর যদি এটি ব্যক্তি নাম হয় তাহলে ইনি জ্ঞানদাসের বন্ধু মনোহর দাস আউলিয়াও হতে পারেন। জ্ঞানদাস ও অন্যান্য সকলেই জাহ্নবীদেবীর সঙ্গে খেতুরীরর মহোৎসবে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরা যে জাহ্নবীদেবীর সঙ্গে খেতুরীরর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন, তার উল্লেখ আছে ‘ভক্তিরত্নাকর’ এর দশম তরঙ্গে-
শ্রী মীনকেতন রামদাস মনোহর।
মুরারি-চৈতন্য জ্ঞানদাস মনোহর।।
খেতুরীর মহোৎসব হয় ষোড়শ শতকের শেষভাগে। এই উৎসবের তারিখ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রমাকান্ত চক্রবর্তী অনুমান করেছেন ১৬১০ থেকে ১৬২০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে খেতুরীতে প্রথম বৈষ্ণব সম্মেলন হয়। কবি জ্ঞানদাস এই উৎসবে যোগদান করেছিলেন। এ সময় নিশ্চয় তিনি তরুণ বা যুবক ছিলেন না। জাহ্নবীদেবীর সঙ্গে খেতুরীতে বর্ধমানের যে সকল বৈষ্ণব একসঙ্গে গিয়েছিল, তাহলে নিশ্চিত এদের পারস্পারিক আলাপ পরিচয় ছিল। ‘শ্রী ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ (১/৫) বলা হয়েছে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ঝামটপুরের বাড়িতে অষ্টপ্রহর কীর্তনের দিনে মীনকেতন রামদাস উপস্থিত ছিলেন। সহজেই অনুমেয় যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের সঙ্গে মীনকেতনের জানাশুনা ছিল। মীনকেতনের সূত্রে জ্ঞানদাসের সঙ্গে কৃষ্ণদাস কবিরাজের যোগাযোগ হওয়া সম্ভব। কৃষ্ণদাসের জন্ম হয় ১৫১৯ খ্রীঃ থেকে ১৫২৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তার ঝামটপুরের (বর্ধমান) বাড়িতে, একদা সংকীর্তনকালে নিত্যানন্দের অবমাননা করা হলে সে রাতেই তিনি নিত্যানন্দের দর্শন পান স্বপ্নে। প্রভু নিত্যানন্দ তাঁকে স্বপ্নে বলেন-
আয় আয় কৃষ্ণদাস না কর ভয়।
বৃন্দাবনে যাই তাঁহা সর্বলভ্য হয়।।
এরপর তিনি বৃন্দাবনে চলে যান। সম্ভবত তার বয়স তিরিশ বছর। চৈতন্যচরিতামৃত তাঁর বৃদ্ধ বয়সের রচনা।
আমি বৃদ্ধ জরাতুর লিখিতে কাপায়ে কর
মনে কিছু স্মরণ না হয়।
না দেখিয়ে নয়নে না শুনিয়া শ্রবণে
তবু লিখি এ বড় বিষ্ময়।।
বৃদ্ধ বয়সের এই রচনায় কৃষ্ণদাস নিত্যানন্দ শাখার বর্ণনায় জ্ঞানদাসের নাম উল্লেখ করেছেন।
নরহরি চক্রবর্তীর পিতা জগন্নাথ ছিলেন বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর শিষ্য। বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ শ্রীকৃষ্ণভাবনামৃত’ ও ভাগবতের ‘সারার্থদর্শিনী’ টীকা গ্রন্থদ্বয়ের রচনা সমাপ্ত হয় যথাক্রমে ১৬০১ শতক অর্থাৎ ১৬৭৯ খ্রীঃ ও ১৭০৪ খ্রীঃ। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায় নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ ও ‘নরোত্তমবিলাস’ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রচিত। ফলে নরহরির বিবরণ কতটা প্রামাণ্য সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। তবে খেতুরীর মহোৎসব গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উৎসবে কে কে উপস্থিত ছিলেন সে বিষয়ে কিংবদন্তি প্রচলিত থাকা স্বাভাবিক।
অষ্টাদশ শতাব্দীর চতুর্থ পদে সাধক বৈষ্ণবদাস নানাস্থানে ভ্রমণ করে প্রায় ৩১০৩ টি পদ সংগ্রহ করে ‘পদকল্পতরুর’ সংকলন করেন। গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে প্রথমে শ্রী চৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈত প্রমুখের স্তবের পর স্বরূপ দামোদর, গদাধর, রামানন্দ, শ্রীনিবাস, গদাধর দাস, নরহরি সরকার, মুরারি গুপ্ত, মুকুন্দ, রামানন্দ রায়, হরিদাস প্রমুখ ভক্ত কবির বন্দনা করে নবম পদে জ্ঞানদাসের নামোল্লেখ করেছেন।
বসু রামানন্দ সেন শিবানন্দ
গোবিন্দ মাধব বাসু ঘোষ
জয় বৃন্দাবন দাস গৌর রসে
জগ জনে করল সন্তোষ।।
জয় জয় অনন্ত দাস নয়নানন্দ
জ্ঞানদাস যদুনাথ।
শ্রীরূপ সনাতন জয় জয় শ্রীজীব
ভট্ট যুগল রঘুনাথ।।
এই পদে রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ ভট্ট, রূপ সনাতন, রমানন্দ বসু প্রত্যেকেই প্রায় শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক। বৃন্দাবন দাস শ্রীচৈতন্যের দর্শন করেননি। শ্রীজীব অতি শিশুকালে চৈতন্য কে দর্শন করেন। জ্ঞানদাস নিজেই বলেছেন-
যাহাতে ধরণী ধন্য, বিশেষে নদীয়া।
জ্ঞানদাস বড় দুঃখী তাহা না দেখিয়া।।
অন্য আরেকটি পদ আছে –
জ্ঞানদাস হাট শেষে আওল
পাওল আপন স্বভাবে।।
পদটি ১৩৬৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জ্ঞানদাসের পদাবলী গ্রন্থের পঞ্চম পৃষ্ঠায় রয়েছে। নদীয়াপুরে গৌরিচন্দ্রের হাট শেষে জ্ঞানদাস এলেন অর্থাৎ মহাপ্রভুর তিরোধানের পর তাঁর আগমন। সুতরাং চৈতন্যদেবকে তিনি দর্শন করেননি, একথার প্রমাণ তাঁর স্বরচিত পদ। তিনি চৈতন্য পরবর্তী সময়ের কবি।
উল্লিখিত বৈষ্ণবদাসের লেখা পদটিতে রয়েছে। চৈতন্য সমসাময়িক থেকে সামান্য পরবর্তী সময়ের কবি ও সাধকদের কথা। আচার্য, নরোত্তম ঠাকুর রামচন্দ্র কবিরাজ, গতি গোবিন্দ, গোবিন্দ দাস কবিরাজ, গোবিন্দ চক্রবর্তী, শ্যামাদাস, ব্যাস, রামচরন, রামকৃষ্ণ, কুমুদানন্দ, রূপঘটক, বীরহাম্বীর, কনপূর, গোকুলদাস, ভগবানদাস, গোপীরমণ, নরসিংহ, বল্লবিকান্ত, বল্লভ, যদুনন্দনদাস, কবি, নৃপ, বংশ অর্থাৎ গোবিন্দবিরাজের বংশোদ্ভূত ঘনশ্যাম ও বলরামের স্মৃতি আছে ‘পদকল্পতরুর’ ১৮ সংখক পদে। এঁদের সঙ্গে বৈষ্ণবদাস জ্ঞানদাসের উল্লেখ করতে পারেননি। এর কারণ হতে পারে এদের পূর্ববর্তী বলেই নবম পদে জ্ঞানদাসের কথা তিনি বলেছেন।
ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার অনুমান করেছেন জ্ঞানদাস নিত্যানন্দ প্রভুর লীলা দর্শন করেছেন। বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ‘ক্ষনদাগীতচিন্তামণি’ তে ত্রিশটি ক্ষণদার প্রত্যেকটিতে গৌরচন্দ্রিকার ঠিক পরেই রয়েছে নিত্যানন্দচন্দ্রিকার একটি করে পদ। নিত্যানন্দ বিষয়ক পদগুলির মধ্যে তিনটি পদ জ্ঞানদাসের লেখা। বলরাম দাস ও বৃন্দাবন দাসের নামে তিনটি করে পদ রয়েছে। এরা দুজনেই ছিলেন নিত্যানন্দের ঘনিষ্ট। শ্রীচৈতন্যের আদিখন্ডের একাদশ পরিচ্ছেদ একথার প্রমাণ বহন করে। অধ্যাপক মজুমদারের মতে জ্ঞানদাস রচিত তিনটি নিত্যানন্দ বিষয়ক পদে প্রতক্ষদর্শীর অনুভূতির স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ‘গৌর-পিরীতরসে কটির বসন খসে, অবতার অতি অনুপাম’ – স্বচক্ষে না দেখলে গৌর রসে মজে নিত্যানন্দের কটির বসন খসে যাওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন সম্ভব ছিল না। চৈতন্যভগাবতে বৃন্দাবন দাসের উক্তি জ্ঞানদাসকে সমর্থন করে। সেখানে রয়েছে শ্রীগৌরাঙ্গের কথা বলতে বলতে নিত্যানন্দ ‘দিগম্বর হই বস্ত্র বান্ধিলেন শীরে’ (২/১১)। ভাব সাগরে সদা নিমজ্জ নিত্যানন্দ পরণের কাপড় ভাল করে সামলাতে পারতেন না বলেই বোধ হয় মাল কোঁচা দিয়ে কাপড় পরতেন। জ্ঞানদাসের – ‘দেখরে ভাই। প্রবল-মল্ল-রূপ-ধারী’ পদটি পাঠ করলে বোঝা যায়, কবি যেন স্বয়ং দেখেছেন এবং সেই রূপ অপরকে দেখিয়ে বলছেন, ‘কটি তটে বিবিধ-বরণ-পটপরিহণ’। প্রশ্ন জাগে জ্ঞানদাস কি বহুবর্ণ কাপড় পরিহিত নিতাইকে দেখেছিলেন? বৃন্দাবন দাস চৈতন্যভাগবতে বলেছেন-
শুক্লপট্ট নীল পীত- বহুবিধ বাস।
অপুট শোভয়ে পরিধানের বিলাস।। (৩/৫)
হতে পারে, নিত্যানন্দের বহুবর্ণময় পরিধানের বিলাসের কথা প্রচারিত ছিল বলেই জ্ঞানদাসও অনুরূপ কল্পনা করেছেন বা লোকমুখে শুনে লিখেছেন। কিন্তু কবি যখন বলছেন –
নাম নিতাই, ভায়া বলি রয়ত
লীলা বুঝাই না পারি।।
ভাবে বিঘূর্ণিত লোচন ঢর ঢর,
দিগ বিদিক নাহি যান।।
মত্ত সিংহ যেন গরজে ঘন ঘন,
জগ-মাহ কাহু না মান।।
স্বাভাবিক ভাবেই ‘ভায়া বলি রোয়ত’ কিংবা নিত্যানন্দের ভাবাবিস্ট রূপের এরূপ বর্ণনায় মনের মধ্যে প্রশ্ন উকি দেয়। প্রত্যক্ষ দর্শন ছাড়া কি এই পদ রচনা সম্ভব? জ্ঞানদাসের তৃতীয় পদটিও অনুরূপ চিত্রময়।
আরে মোর আরে মোর, নিত্যানন্দ রায়।
আপে নাচে আপে গায় চৈতন্য বলায়।।
লম্ফে লম্ফে যায় নিতাই গৌরাঙ্গ আবেশে
পাপিয়া পাষণ্ড মতি রাখিল দেশে।।
পাট বসল পড়ে নিতাই, মুকুতা শ্রবণে।
ঝলমল ঝলমল নানা আভরণে।।
প্রমাণিকতায় নিত্যানন্দ সমসাময়িক হিসেবে যারা পরিচিত তাদের পদেও অনুরূপ চিত্র লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অনিসন্ধিৎসুদের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে জ্ঞানদাস নিত্যানন্দকে দেখলেন কবে? চৈতন্যদেবের তিরোধনের আট দশ বছর পর নিত্যানন্দ প্রভু লীলা সম্বরণ করেন। মহাপ্রভুর তিরোভাব ঘটে ১৫৩৩ খ্রীঃ। সে হিসেবে নিতাই প্রভু দেহত্যাগ করেন ১৫৪১-৪৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে। ‘ক্ষণদাগীত চিন্তামণি’তে জ্ঞানদাসের নিত্যানন্দ বিষয়ক পদগুলি চাক্ষুষ দর্শনের পরিণাম হিসেবে মেনে নিলে বলা যেতে পারে নিতান্ত বাল্যকালে তিনি নিত্যানন্দকে দেখেছিলেন। বড় হয়ে জাহ্নবী দেবীর কাছে দীক্ষা মন্ত্র গ্রহণ করেন। পরিণত বয়সে তিনি নিত্যানন্দ পুত্র বীরচন্দ্র প্রভুর বর্ণনা লিখেছেন।
আদাম যোগ পুরাণ বেদান্তক
মহিমা বুঝাই না পারি।
সো পহুঁ ঘরে ঘরে, পতিত বহিঞা (ফিরে?)
দেই যে প্রেম লছিমি ভিখারি।।
…
দেখ বীরচান্দকি লীলা।
পদে উল্লেখিত ‘বীরচন্দ্র’ নিত্যানন্দ বীরচন্দ্র ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু বৈষ্ণব সাহিত্য আশ্চর্যভাবে তাঁর সম্পর্কে নীরব। যাই হোক এই আলোচনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, জ্ঞানদাস দীর্ঘায়ু ছিলেন। তাঁর জন্ম হয় ১৫৩০ খ্রীষ্টাব্দ বা তার দু-এক বছর আগে বা পরে এবং মৃত্যু অবশ্যই খেতুরীর মহোৎসব পরবর্তী কোন এক সময়ে।
জ্ঞানদাসের পদসম্ভার
মধ্যযুগে আমরা একাধিক কবির সন্ধান তো পেয়েই থাকি। চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস নামে একাধিক কবি বিদ্যমান ছিলেন। এই সূত্রে একাধিক জ্ঞানদাস ছিলেন কিনা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সুকুমার সেন বলেছেন, ‘জ্ঞানদাস (ও জ্ঞান) উভয় ভনিতায় অনেক পদ পাওয়া মিলিয়াছে’। এপ্রসঙ্গে তিনি জ্ঞানদাসের পদাবলীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সাহিত্যসভার খণ্ডিত পুঁথির উল্লেখ করেছেন। তবে জ্ঞানদাসের নামে ব্রজবুলি ও বাংলা উভয় ভাষারীতিরই পদ পাওয়া যায়। ‘পদকল্পতরু’তে ১৮৬ টি পদে জ্ঞানদাসের ভনিতা আছে। তার মধ্যে ১০৫ টি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত। গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দলীলা ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক লীলা উভয় বিষয়ে তিনি পদ রচনা করেছেন। তাঁর পদ গুলি পড়লে বোঝা যায়, বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস রামানন্দের অনুকরণে তিনি তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। ‘পদকল্পতরু’তে গৃহীত জ্ঞানদাসের অধিকাংশ পদ ব্রজবুলিতে লেখা। তাঁর ব্রজবুলির পদগুলিতে আছে বিদ্যাপতির প্রভাব। সে সকল পদে ব্রজবুলির ধ্বনিঝংকার ও ছন্দের দোলন পাঠকের কাছে সুখ দায়ক হলেও কার্যক্রমে ততটা উৎকৃষ্ট নয়। অবশ্য দু চারটি ব্রজবুলির ভাষার পদ অবশ্যই ব্যতিক্রম।
লহু লহু মুচকি হাসি হাসি আওলি
পুন পুন হেরসি ফেরি।
জনু রতিপতি সঞে মিলন রঙ্গভুমে
ঐছন কয়ল পুছুরি।।
ধনী হে বুঝলু এসব বাত।
এতদিনে দুহুঁক মনরথ পুরল
ভেটলি কানুক সাধ।।
জ্ঞানদাসের প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ বাংলা ভাষার পদগুলিতে। সহজ সরল রীতিতে রচিত তাঁর বাংলা পদগুলি অন্তর্মুখী ও ভাবসমৃদ্ধ। এ সকল পদের সরল কথ্য বাংলা পয়ার ত্রিপদীর নিপুণ প্রয়োগ লক্ষণীয়।
বিংশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম রমণীমোহন মল্লিক মহাশয় (১৩০২ সালে) জ্ঞানদাসের পদাবলীর সংকলন গ্রন্থে আরও কিছু পদ যুক্ত করেন। ১৩০৪ সালে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ‘প্রাচীন কবির গ্রন্থাবলী’র দ্বিতীয় ভাগে জ্ঞানদাসের ৩০৫ টি পদ পাকাশ করেন। এই সংকলনে রমণীবাবুর কয়েকটি পদ পরিত্যক্ত হয় এবং অনেকগুলি নতুন পদ যুক্ত হয়। ১৩১২ সালে দুর্গাদাস লাহিড়ী ‘বৈষ্ণবপদলহরী’তে ৩০৪ টি পদ সংকলন করেন। ১৩২৭ সালে সতীশচন্দ্র রায় পাবনা জেলার সাহাজাদপুর গ্রাম থেকে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তিনি ‘পদরসসার’, ‘পদরত্নাকর’ প্রভৃতি প্রাচীন পুঁথি গুলি থেকে প্রায় ৫৩/৫২ টি পদের নতুন সন্ধান পান। সেগুলি তাঁর ‘অপ্রকাশিত পদরত্নাবলী’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। অবশ্য সবকটি পদ নতুন নয়। শ্রী সুকুমার ভট্টাচার্য ‘যশোদার বাৎসল্য লীলা’ নামে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন ১৩৪৭ সালে। সেখানে জ্ঞানদাসের ভনিতায় ২০ টি বাৎসল্যলীলার পদ রয়েছে। পদগুলি আকারে আতি দীর্ঘ। কিন্তু পালাটি অত্যন্ত বর্ণহীন। পদগুলির কবিত্ব ও রচনাভঙ্গী দুর্বল। জ্ঞানদাসের রচনার সঙ্গে সাধারণ পাঠক বিদগ্ধ মহল সুপরিচিত। ফলে এ রচনা তাঁরই কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। জ্ঞানদাসের ভনিতায় প্রায় আড়াইশো পদ পাওয়া যায়। ১৩২৭ সালে বিমানবিহারী মজুমদার ‘জ্ঞানদাস ও তাঁহার পদাবলী’ গ্রন্থে ৫০৪ টি পদ সংকলন করেন। ১৩৬৩ সালে পণ্ডিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩৬৩ টি সম্পূর্ণ ও ৩১ টি অসম্পূর্ণ পদ প্রকাশ করেন। এই সংকলনে তিনি বহু সংখ্যক পদের নতুন পাঠ প্রকাশ করেন।অথচ এই বিপুল সংখ্যক পদের পাঠান্তর তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন সে বিষয়ে মূল পুঁথি বা প্রয়োজনীয় উৎসের উল্লেখ করেননি। এ কারনেই জ্ঞানদাস নামে একাধিক কবি বর্তমান ছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে। ডঃ সুকুমার সেন একাধিক জ্ঞানদাসের রচনা অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেও প্রমাণের অভাবে সমস্ত পদই জ্ঞানদাসের বলে স্বীকৃতি করেছেন। কিন্তু অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যশোদার বাৎসল্যলীলা’ পুথিতে জ্ঞানদাস নামঙ্কিত পদগুলি পদাবলীকার জ্ঞানদাসের রচনা বলে স্বীকার করেননি।