১।
শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম একটি বন্দনা শ্লোকে তাঁকে বলা হয়েছে সংকীর্তন-পিতা। মনে করা হয়, বাংলা জুড়ে কীর্তনের যে অপ্রতিহত প্রভাব, তাঁর উৎসমুখে আছেন তিনিই। কীর্তন বা সংকীর্তনের গুরুত্ব তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। সত্যি কথা বলতে, কীর্তন একদিকে যেমন ভক্তহৃদয়ের তদ্গত নিবেদন, তেমনই আবার তা একটি শিল্পমাধ্যম। এমন শিল্প যা একদিকে ধারণ করে আছে বাংলার সেরা সাহিত্যরূপ, অন্যদিকে তা পারফরম্যান্সের পরাকাষ্ঠা – গীত, বাদ্য, নৃত্য, অভিনয় সব মিলে গেছে এই গেয়-অভিনেয় মাধ্যমে। এখানেই শেষ নয়, কীর্তনকে আবার একটি সংগঠন হিসেবেও ভাবা যেতে পারে। যে-সংগঠন চৈতন্যদেব শুরু করেছিলেন সমাজের সব-স্তরের মানুষকে একটি সমতলে এনে মেলাবার জন্য; এবং প্রচারের উপায় হিসেবে। যে-সংগঠনটি পাঁচশো বছর পেরিয়ে এখনো টিঁকে আছে; আজও স্বতস্ফূর্ত এগিয়ে আসেন মানুষ, দেখ-না-দেখ তৈরি হয়ে যায় কীর্তনের আসর। আজও নানা দুর্বিপাকে পড়লে মানুষ কীর্তনের মাধ্যমে তা থেকে মুক্তির পথ খোঁজেন – আমাদের মতে এই মুক্তি শুধু কীর্তনের আধ্যাত্মিক সংযোগ থেকে আসেনা, আসে কীর্তনের অনেক মানুষকে একত্র করবার ক্ষমতা থেকেও। বৈষ্ণবেরা বলেন, কীর্তন একই সঙ্গে সাধ্য ও সাধন। ইংরেজি করে বললে বুঝতে সুবিধে হবে হয়তো – মিন্স অ্যান্ড এন্ড। অর্থাৎ কীর্তন সাধনার লক্ষ্য যেমন, তেমনই তা সাধনার পথও বটে। খেয়াল করুন, সাধন মার্গের ক্ষেত্রে যতটা, ততটাই সামাজিক বিচারেও একথা সত্যি। কীর্তন সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে, একইসঙ্গে লক্ষ্য এবং উপায়।
মহাপ্রভুর অন্যতম অবদান হিসেবে কীর্তনকে মানুষ মনে রেখেছে, তাঁকেই আমরা কীর্তনের ইতিহাসের শুরু বলে ধরে নিই। কিন্তু তাঁর আগেও কীর্তনের প্রচলন তো ছিল কিছু। হয়তো এই ভাবে বা এই নামে নয়, কিন্তু সম্মেলক বা একক অনুভবের সঙ্গীত প্রাণের দেবতা বা মানুষের উদ্দেশে নিবেদিত তো হতো। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি বা তারও আগে জয়দেবের নাটগীতে কিংবা চর্যার কবিতায় সেই সঙ্গীতের পরিচয় আমরা পাই। মহাপ্রভু থেকে যেহেতু কীর্তন ইতিহাস শুরু করা হয়, তাহলে একে বলা যাক কীর্তনের প্রাক-ইতিহাস। জয়দেব বা চর্যা তো মহাপ্রভুর অনেক দিন আগেকার কথা, তাই এ-দু’য়ের যোগসূত্র খুব স্পষ্ট নয়। কিন্তু মহাপ্রভুর ঠিক আগেই এমন একটি মিসিং লিঙ্ক পাওয়া যেতে পারে, যা থেকে মহাপ্রভুর অবদানের গুরুত্ব আরও ভালো করে বোঝা যায়। কী পরিস্থিতিতে মহাপ্রভুকে সংকীর্তনের পিতা হয়ে উঠতে হলো তা বোঝার জন্য তাঁর পূর্বসূরীদের কাজের সাপেক্ষে তাঁকে পড়তে হবে। এই লেখায় আমরা সেইরকম একজন পূর্বসূরীর কথাই আলোচনা করব। এই মিসিং লিঙ্কের নাম মাধবেন্দ্র পুরী, ইনি মহাপ্রভুর পরমগুরু। অর্থাৎ মহাপ্রভুর গুরুদেব ঈশ্বর পুরীর গুরু হলেন এই মাধবেন্দ্র পুরী। এঁর পরিচয় ধীরে ধীরে দেবার চেষ্টা করব, আপাতত এইটুকু উল্লেখ থাক যে, শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং এঁকে ভক্তিরসের আদি সূত্রধার বলেছেন –
ভক্তিরসে মাধবেন্দ্র আদি সূত্রধার।
স্বয়ং শ্রীগৌরচন্দ্র ইহা কহিয়াছেন বারবার।।
মাধবেন্দ্র পুরী যখন বৃন্দাবনের গোপালের আদেশে নীলাচলে চলেছেন চন্দন আনতে, সেই সময় পথে একদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন রেমুণায় গোপীনাথের মন্দিরে। গোপীনাথের ক্ষীরপ্রসাদ খুব বিখ্যাত, তখন সেই ভোগেরই বন্দোবস্ত হচ্ছে। মাধবেন্দ্রের মনে হয়েছিল, আহা, একটু ক্ষীরপ্রসাদ যদি পেতাম, তবে স্বাদ জেনে বৃন্দাবনে ফিরে আমার গোপালকে এই ভোগ লাগাতে পারতাম। কিন্তু যে মুহূর্তে এই বাসনা মনে উদয় হলো, তিনি শিউরে উঠলেন। মাধবেন্দ্র ছিলেন অযাচক বৃত্তিধারী — ‘অযাচিত বৃত্তি পুরী বিরক্ত উদাস’। ফলে চাওয়া তাঁর জন্য অপরাধ; সে চাওয়াটা মনে মনে হলেও। তার ওপর কৃষ্ণপ্রেমিক মানুষ, কৃষ্ণসেবাই তাঁর প্রাণ। সেই তিনি কীনা ঠাকুরকে নিবেদন করার আগেই ভোগের ওপর লোভ করে ফেললেন! প্রবল আত্মগ্লানিতে মাধবেন্দ্র ঠাকুরকে প্রণাম করে মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। এসে বসে আছেন গ্রামের শূন্য হাটে। ভাঙা হাট বলতেই আমাদের খাঁ খাঁ ভুতুড়ে জায়গার কথা মনে হয়। পাঠক ভেবে নিন, সেই মধ্যযুগের ওড়িশায় মধ্যরাত্রের নিঃঝুম অন্ধকার ভাঙা হাটের রূপটি। সেখানে বসে বসে কী করছেন তিনি? চরিতামৃতে আছে –
গ্রামে শূন্য হাটে বসি করেন কীর্তন।
ভাঙা হাট, মাঝরাত্তির, যেন অযাচক এই সন্ন্যাসীর সেই মুহূর্তের উদাস প্রাণেরই রূপক। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর আমাদের জানা হয়ে যায় – যে, মাধবেন্দ্র কীর্তন করছেন। কীর্তন বা সংকীর্তন চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবের অন্যতম সাধনপথ। মহাপ্রভু নিজে কীর্তনকেই কলিযুগের একমাত্র ধর্ম বা পথ হিসেবে নির্দেশ করে গেছেন – নামসংকীর্তন কলৌ পরম উপায়। কীর্তন ছাড়া মহাপ্রভু বা তাঁর পরিকর-অনুগামী-ভক্ত কাউকে আমরা ভাবতেই পারি না। এতটাই নিবিড় এই সম্পর্ক যে মহাপ্রভুকে, নিত্যানন্দের সঙ্গে যুগ্মভাবে, সংকীর্তন-পিতা বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সংকীর্তনের জনক বা প্রবক্তা। সেজন্যেই চৈতন্যদেবের পরমগুরু মাধবেন্দ্র পুরীর কীর্তন করবার সংবাদ আমাদের একটু ভাবিয়ে তোলে। মাধবেন্দ্র যদি কীর্তন করেন তাহলে মহাপ্রভু কীর্তনের পিতা হন কী ভাবে? রসিকতা করে বলা যায় যে, মহাপ্রভু কীর্তনের পিতা হলে মাধবেন্দ্র পুরী কীর্তনের প্রপিতামহ। অপরাধ নেবেন না; শুধু রঙ্গ করবার জন্য কথাটি বলছি না। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, মাধবেন্দ্র-সূত্রেই চৈতন্য-সম্প্রদায়ে কীর্তনের বিজয়। কেন, সেকথাই এই লেখায় বলবার চেষ্টা করব।
মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে কীর্তনের সম্বন্ধ নিয়ে বলার আগে দু’একটি সাধারণ ধারণা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। যেমন কীর্তন বলতে কী বুঝব? হয়তো এসব কথা সকলেই জানেন, তবু সংক্ষেপে উল্লেখ করছি, যাতে আমাদের পরবর্তী বক্তব্য স্পষ্ট হয়। ভগবানের মহত্ত্ব, করুণা এবং ভক্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক — এই নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই কবিতা-গান-গল্প লেখা হয়েছে, গাওয়া হয়েছে। সহজ করে বলা যায় যে, ঈশ্বরের নাম-লীলা-গুণ এইসব নিয়ে যা কীর্তিত হয় তাই-ই হলো কীর্তন। ভারতের সমস্ত মান্য বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মূল গ্রন্থ হলো ভাগবত পুরাণ; তাঁদের সম্প্রদায়গত বিচারে এই পুরাণের রচয়িতা হলেন স্বয়ং ব্যাসদেব। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতেও ভাগবত পুরাণ অন্ততঃ দশম শতাব্দীর আগে রচিত হয়েছে, অর্থাৎ যথেষ্ট পুরোনো। সেই ভাগবত পুরাণে দেখি দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু পুত্র প্রহ্লাদের কাছে তাঁর লেখাপড়ার হালহকিকত জানতে চাইছেন। তখন প্রহ্লাদ বলছেন নবধা ভক্তির কথা। প্রহ্লাদের উওক্তিতেই আমরা জেনে যাই যে ভক্তির ন’টি অঙ্গ বা পথের মধ্যে প্রথমটি শ্রবণ, আর দ্বিতীয়টিই হলো কীর্তন। মনে রাখতে হবে, শ্রবণ হলো কীর্তনেরই পরিপূরক অঙ্গ, কেউ শুনলে তবেই তো কেউ গাইবে। একটি ছাড়া অপরটি সম্ভব নয়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বৈষ্ণবধর্ম – যাকে ভাগবতধর্মও বলা হয় – তার শুরু থেকেই সাধনপথ হিসেবে কীর্তনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথম যে-অঞ্চলে বৈষ্ণব-ভক্তির উন্মেষ হয়, সেই দক্ষিণ ভারতের আলবার বা আড়বার কবিদের অসংখ্য গান এই কীর্তনের ধারার অঙ্গ। আমাদের গৌড়বঙ্গের সীমানার ভেতর বড়ু চণ্ডীদাস হোন আর জয়দেব গোস্বামী, এই কীর্তনের ঐতিহ্যই বহন করছেন। সুতরাং কীর্তনের ইতিহাস সুদীর্ঘ ও সুপ্রাচীন। তবে চৈতন্যদেব যে কীর্তনকে বাংলায় ছড়িয়ে দিলেন, ইতিহাসের এই প্রবাহের মধ্যেও তা কিন্তু বিশিষ্ট। কীর্তন হয়ে উঠল একইসঙ্গে সাধ্য ও সাধন; কীর্তন ভক্তিযাজনের পথও বটে আবার গন্তব্যও বটে। কীর্তনের এই দ্বৈত ভূমিকার ব্যাপারটি আগেও উল্লেখ করেছি। আপাতত আর একটি জিনিস খেয়াল করতে বলব, কীর্তন যেমন চৈতন্য-পন্থার বিস্তারে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে; তেমনই তা আবার চৈতন্য-পন্থীদের একসূত্রে বেঁধেও রেখেছে। হিতেশরঞ্জন সান্যাল যথার্থ বলেছেন যে, কীর্তন হলো চৈতন্য-আন্দোলনের প্রধান সংগঠন।
এখন যা বিচার্য, মাধবেন্দ্র পুরীর যে কীর্তনের কথা জানা যাচ্ছে, তা কি শুধুই ভক্তের নিবেদন বা প্রার্থনা? নাকি মাধবেন্দ্রের কীর্তন-প্রবণতার মধ্যে, চৈতন্যদেবের হাতে কীর্তন যে-রূপ পরবর্তীকালে গ্রহণ করল, তার বীজটি নিহিত ছিল? তার মধ্যেই কি পূর্বাভাস ছিল ব্যাপক সামাজিক প্রভাব-বিস্তার করবার মতো কোনো সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য?
মাধবেন্দ্র বিষয়ে চৈতন্য-জীবনীগুলিতে যা টুকরো-টাকরা উল্লেখ পাওয়া যায়, তার মধ্যে থেকেই আমাদের উত্তর-সন্ধান করতে হবে। মাধবেন্দ্র বিষয়ে সবচেয়ে বিস্তৃত আকারে বর্ণনাটি রয়েছে চৈতন্যচরিতামৃত-এর মধ্যলীলার চতুর্থ পরিচ্ছেদে। সকলেই জানেন যে, মধ্যলীলা শুরু হচ্ছে মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণ থেকে। তো সন্ন্যাসের পর মহাপ্রভু যখন নীলাচল পুরীতে যাচ্ছেন, সেই পথে পড়ছে রেমুণা। ওড়িশার বালেশ্বর জেলায় এই রেমুণায় রয়েছে ক্ষীরচোরা গোপীনাথের মন্দির। মহাপ্রভু সেই মন্দিরে গোপীনাথকে দর্শন করে আনন্দে অধীর হয়ে উঠছেন। সেখানে প্রসাদ পাচ্ছেন আর তারপর সঙ্গীদের নিয়ে ইষ্টগোষ্ঠী করছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন নিত্যানন্দ, দামোদর, মুকুন্দ ও জগদানন্দ। এঁদের তিনি শোনাচ্ছেন কী ভাবে এই গোপীনাথের ক্ষীরচোরা নাম হলো সেই বৃত্তান্ত। এ গল্প তিনি শুনেছেন নিজের দীক্ষাগুরু ঈশ্বর পুরীর কাছে, আর এই গল্পের নায়ক হলেন তাঁর পরমগুরু অর্থাৎ ঈশ্বর পুরীর গুরু মাধবেন্দ্র পুরী।
বোঝাই যায়, কবিরাজ গোস্বামী স্বয়ং মহাপ্রভুকে যে-কাহিনির কথক হিসেবে উপস্থিত করছেন সে-কাহিনি এলেবেলে নয়। তার আলাদা গুরুত্ব আছে। কাহিনিটি বলতে গিয়ে মহাপ্রভু একটু পিছিয়ে যাচ্ছেন, চলে যাচ্ছেন বৃন্দাবনে, যখন সেখানে হাজির হয়েছিলেন পরিব্রাজক মাধবেন্দ্র। সেখানে গোবর্ধন পরিক্রমা করে তিনি গোবিন্দ কুণ্ডের তীরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, এমন সময় একটি গোপবালক এসে তাকে এক ভাঁড় দুধ দিয়ে যায়। রাতে মাধবেন্দ্র পুরীর স্বপ্নে সেই বালক এসে নিজেকে গোবর্ধনধারী গোপাল বলে পরিচয় দেয়। সে বলে যে, অরণ্যের ভেতর এক কুঞ্জে তাঁর বিগ্রহ লুকিয়ে রাখা আছে। সকাল হতে স্থানীয় ব্রজবাসীদের সাহায্যে মাধবেন্দ্র সেই বিগ্রহ উদ্ধার করেন এবং গোপালের স্বপ্নাদেশ অনুসারে তাঁকে গোবর্ধনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। গ্রামের মানুষের সাহায্যে সেখানে মহা ধুমধামে অভিষেক, ভোগরাগ সম্পন্ন হয়। এই পুরো বৃত্তান্ত বিস্তারিত বলতে পারলে হয়তো ভালো হতো, এই বিগ্রহ পেয়ে মাধবেন্দ্র পুরীর অনুভূতি আরো ভালো বোঝা যেত, কিন্তু আপাতত আমরা নজর দেব একটি বিশেষ দিকে। নৃত্য-গীত-কীর্তনের প্রতি মাধবেন্দ্র পুরীর একটি স্বাভাবিক প্রবণতা এই বৃত্তান্ত থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মহাপ্রভুকে আমরা চিনি তাঁর নৃত্যগীত এবং প্রেমাবেশের কারণ। মহাপ্রভুর পরমগুরুর মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করবার মতো। মাধবেন্দ্র যখন বৃন্দাবনে আসছেন তখন তাঁর অবস্থা কেমন?
প্রেমে মত্ত নাহি তাঁর দিবারাত্রি জ্ঞান।
ক্ষণে উঠে ক্ষণে পড়ে নাহি স্থানাস্থান।।
আবার নাম করতে করতে তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছেন, বালক তাঁকে স্বপ্নে এসে আত্মপরিচয় দিয়ে গেছে, জেগে উঠে মাধবেন্দ্র কী করছেন?
শ্রীকৃষ্ণ দেখিলুঁ মুঞি নারিলুঁ চিহ্নিতে।
এত বলি প্রেমাবেশে পড়িলা ভূমিতে।।
ক্ষণেক রোদন করি মন কৈল স্থির।
যখন বিগ্রহ আবিষ্কার হয়েছে, তাঁকে সবাই মিলে পাহাড়ের ওপর নিয়ে গেছে, গোবিন্দ কুণ্ডের জল শত শত ঘট ভরে এনে স্নান করানো হচ্ছে, তখন সকলে মিলে নৃত্যগীত করছেন –
নানা বাদ্য ভেরী বাজে স্ত্রীগণে গায় গীত।।
কেহো গায় কেহো নাচে মহোৎসব হৈল।
অতএব আমরা দেখি যে, মাধবেন্দ্র নানা সময় প্রেমাবিষ্ট হয়ে পড়তেন। দেখি যে, তিনি কাঁদছেন, মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন, প্রেমের আবেশে তাঁর বাহ্যজ্ঞান অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সকলে যখন নৃত্যগীত করছে, বাদ্য বাজাচ্ছে, মাধবেন্দ্রর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও উৎসাহ তাতে রয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু তিনি নিজে কি নৃত্যগীত করতেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য আমাদের দেখতে হবে কাহিনির পরের অংশ।
বছর দুয়েক গোপালের সেবা করবার পর আবার স্বপ্নাদেশ হলো যে, নীলাচল থেকে মলয় চন্দন নিয়ে আসতে হবে গোপালের তাপ দূর করার জন্য। আর কেউ গেলে চলবে না, স্বয়ং মাধবেন্দ্রকেই যেতে হবে নীলাচলে। এইরকম আদেশ পেয়ে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন কি মাধবেন্দ্র? জানা যায় না, কারণ চরিতামৃতে বলা হচ্ছে –
স্বপ্ন দেখি পুরী গোসাঞির হৈল প্রেমাবেশ।
পুরী গোঁসাই চললেন নীলাচলে। পথে পড়ল রেমুণা, যে-কথা আমরা আগে বলেছি। অতএব তিনি গোপীনাথ মন্দিরে এসে হাজির হলেন। গোপীনাথকে দেখে তিনি কী করছেন লক্ষ্য করুন।
রেমুণাতে কৈল গোপীনাথ দরশন।
তাঁর রূপ দেখি প্রেমাবিষ্ট হৈল মন।।
নৃত্যগীত করি জগমোহনে বসিলা।
খেয়াল করুন, সন্ন্যাসী এসেছেন দূরদেশে। সেইখানে ঠাকুরকে দেখে তাঁর পুলক হয়েছে, সুতরাং তিনি খানিকক্ষণ নাচগান করলেন; কোনো সংকোচ নেই। যথেষ্ট বয়সও হয়েছে, পথশ্রমের ক্লান্তি রয়েছে, কিন্তু সেবিষয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই! তিনি নেচেগেয়ে খুশি। এরপর তিনি মন্দিরের জগমোহনে বসে পূজারী ব্রাহ্মণের কাছে জানতে চাইলেন সেখানকার সেবার খুঁটিনাটি। পূজারী জানালেন যে, ভোগরাগ নানা রকম হয়, তবে তার মধ্যে সন্ধেবেলায় ক্ষীর ভোগ হয়। বিশেষভাবে তৈরি সেই ক্ষীর এতই উপাদেয় যে তার নাম অমৃতকেলি। এইসব আলোচনা করতে করতেই সন্ধে হয়ে এল, আর বারোটি মাটির পাত্রে অমৃতকেলি ভোগ লাগল। তারপরেই তাঁর এই ক্ষীরের স্বাদ নেবার সাধ হবে, সেই সাধ থেকে অনুশোচনা হবে এবং তিনি চলে যাবেন মন্দির ছেড়ে। যেমন আমরা আগেই জেনেছি, এরপর তিনি –
গ্রামে শূন্য হাটে বসি করেন কীর্তন।
অর্থাৎ শুধু আনন্দের অভিব্যক্তি হিসেবে কীর্তন করা নয়, বিষাদেও মাধবেন্দ্র কীর্তনেরই আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এদিকে গোপীনাথ রাত্রে পূজারীকে স্বপ্নে বললেন যে, মাধবেন্দ্রের জন্য তিনি নিজেই আঁচলের তলায় একভাঁড় ক্ষীর লুকিয়ে রেখেছেন, মাধবেন্দ্রকে সেই ক্ষীরপ্রসাদ দিয়ে আসা হোক। পূজারী যখন খুঁজে খুঁজে মাধবেন্দ্রকে ক্ষীর দিল, তখন –
ক্ষীরের বৃত্তান্ত তাঁরে কহিল পূজারী।
শুনি প্রেমাবিষ্ট হৈলা শ্রীমাধবপুরী।।
প্রেম দেখি সেবক কহে হইয়া বিস্মিত।
কৃষ্ণ সে ইহার বশ হয় যথোচিত।।
এই যে প্রেমের কথা আমরা বারবার দেখছি, এটাই মাধবেন্দ্র পুরীর বৈশিষ্ট্য। এরপর যখন মাধবেন্দ্র নীলাচলে আসবেন তখন জগন্নাথ দর্শন করেও তাঁর বিহ্বল অবস্থা হবে।
প্রেমাবেশে উঠে পড়ে হাসে নাচে গায়।
জগন্নাথ দরশনে মহা সুখ পায়।।
যে-কোনো মন্দিরেই পুরী গোস্বামী যাচ্ছেন, বিগ্রহের সামনে নৃত্যগীত কিন্তু বাদ যাচ্ছে না। নীলাচলে কিছুদিন থেকে চন্দন সংগ্রহ করে ফেরবার পথে তিনি আবার রেমুণায় এলেন। তাঁর জন্য ক্ষীর চুরি করে গোপীনাথ ক্ষীরচোরা উপাধি পেয়ে গেছেন। সেখানে এসে –
গোপীনাথ চরণে কৈলা বহু নমস্কার।
প্রেমাবেশে নৃত্যগীত করিলা অপার।।
আমাদের মনে হয়, বিগ্রহের সামনে নৃত্যগীতের বারম্বার উল্লেখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্যগীত যেন দেবতার উদ্দেশ্যে এই সন্ন্যাসীর নিবেদনের একটি ব্যক্তিগত ধরন। মাধবেন্দ্রের আগে এরকম প্রবণতা পূর্ব-ভারতের কোনো সন্ন্যাসী বা অন্য ভক্তের মধ্যে দেখা গেছে বলে আমার অন্ততঃ জানা নেই। অথচ এর পরে চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে এই নৃত্যগীত একটি সামান্য লক্ষণ হয়ে ওঠে। মনে হয় আরো অনেক কিছুর সঙ্গে এই প্রবণতার পথিকৃৎও হলেন মাধবেন্দ্র। ভুলে গেলে চলবে না যে, এই আখ্যানের কথক স্বয়ং মহাপ্রভু। শ্রোতাদের মধ্যে রয়েছেন মাধবেন্দ্রের শিষ্য (মতান্তরে গুরুভ্রাতা) নিত্যানন্দ প্রভু। কেউ বলতে পারেন যে, মহাপ্রভুর সময়ের অনেক পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ যখন মাধবেন্দ্র আখ্যান লিখছেন, তিনি হয়তো মাধবেন্দ্রের ওপর আরোপ করেছেন মহাপ্রভুর চরিত্রের একতম বৈশিষ্ট্য এই প্রেমাবেশ ও কীর্তন-নর্তন। কিন্তু সে যুক্তি টিঁকবে না কারণ কৃষ্ণদাস কবিরাজের বেশ কিছুদিন আগেই বৃন্দাবন দাস ঠাকুরও লিখেছেন যে,
মাধবেন্দ্র পুরী কথা অকথ্য কথন।
মেঘ দেখিলেই মাত্র হয় অচেতন।।
কালো মেঘ দেখে কৃষ্ণের কথা মনে করে যিনি অচেতন হয়ে পড়েন, তাঁর প্রেমাবেশ বিষয়ে প্রশ্ন করা যায় না। এছাড়া কবিরাজ গোস্বামী শাখা বর্ণনে লিখেছেন,
জয় শ্রীমাধবপুরী কৃষ্ণপ্রেমপুর।
ভক্তি কল্পতরুর তিহোঁ প্রথম অঙ্কুর।।
সুতরাং মাধবেন্দ্রকে আসলে সবাই চিনছেন তাঁর প্রেমভাব দিয়ে। তিনি কোথা থেকে এই প্রেমভক্তি এনেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে যে, তাঁর সূত্রেই এই প্রেম এই কীর্তনপ্রিয়তা ঈশ্বরপুরী হয়ে মহাপ্রভু এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে প্রসারিত হয়।
২।
কথা হলো যে, এই কীর্তন কেমন ছিল? তার রাগ, তাল, গায়নভঙ্গি, গেয় পদ বা শ্লোকের ধরন-ধারন বিষয়ে আমাদের কৌতূহল হয়। সমস্যা এই যে, এবিষয়ে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। কারণ কোনো চরিতগ্রন্থেই এব্যাপারে সুস্পষ্ট উল্লেখ দেখা যায় না। ঠিক যেমন মহাপ্রভুর কীর্তনের স্বরূপ নিয়েও সুস্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয় তার কিছু কিছু অবলিক্ রেফারেন্স নিয়েই। প্রথম বিধিবদ্ধ কীর্তনের রূপটি আমরা পাই নরোত্তম দাস ঠাকুরের সময়ে এসে, যিনি মহাপ্রভুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পরের মানুষ। ঠাকুর মহাশয়ের উদ্যোগে এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সন্তোষ দত্তের পৃষ্ঠপোষণায় আয়োজিত খেতুরি উৎসব বিষয়ে একাধিক বিবরণ পাওয়া যায়। এই উৎসবটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে গৌড়বঙ্গ, ব্রজমণ্ডল এবং শ্রীক্ষেত্র সবজায়গা থেকেই বৈষ্ণবেরা সমবেত হয়েছিলেন; চৈতন্য-অনুগামীদের মধ্যে প্রচলিত নানা পরিবারের মেলবন্ধন ঘটেছিল; গোস্বামীদের শাস্ত্রের সঙ্গে জনপ্রিয় ধারা-উপধারার বৈষ্ণবমতের সাযুজ্য হয়েছিল, আর কৃষ্ণলীলা ও গৌরলীলা গাইবার একটি সর্বজনমান্য পদ্ধতি এখানেই ধার্য হয়েছিল। কিন্তু মহাপ্রভুর পঞ্চাশ বছর পরে এই ঘটনা, অতএব মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে এই ঘটনার ঐতিহাসিক দূরত্ব মোটামুটি একশ বছর। ফলে এই উৎসবের বিবরণ থেকে মাধবেন্দ্রের কীর্তন-পদ্ধতির কোনো হদিশ পাওয়া যাবে না।
তবে খেতুরি উৎসব এবং তার আগে মহাপ্রভু ও তাঁর পরিকরদের কীর্তনের নানান টুকরো বর্ণনা থেকে চৈতন্যপন্থায় কীর্তন-পদ্ধতির একটা সাধারণ ধারণা করা সম্ভব। আমাদের মতে সেই সাধারণ ধারণার ভূমিটিকে মাধবেন্দ্রের শিষ্য-প্রশিষ্য ধারায় বিকশিত বলাই যায়। আর তা থেকেই মাধবেন্দ্র কী গাইতেন, কীভাবে গাইতেন, সেবিষয়ে কিছু অনুমান করা চলে। তবে মনে রাখতে হবে, শত যুক্তিজাল সত্ত্বেও এ কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুমান, প্রমাণিত সিদ্ধান্ত নয়। মহাপ্রভু এবং তাঁর অনুগামীদের মধ্যে আমরা বারবার লক্ষ্য করি কীর্তনের সঙ্গে নৃত্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে আছে। মহাপ্রভু তো নর্তনে খুবই উৎসাহী ছিলেন; কীর্তনে তিনি গাইছেন এমন বর্ণনার থেকে অনেক গুণ বেশি বর্ণনা আছে তাঁর নাচের। কেউ গাইছেন, তিনি নাচছেন, বা সকলে মিলে গাইছেন তিনি নাচছেন, কিংবা সকলে মহাপ্রভুর সঙ্গে গাইছেন ও নাচছেন। নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীবাস সকলেই নৃত্যপর ছিলেন। বক্রেশ্বর পণ্ডিত তো নাচের জন্যই বিখ্যাত। মহাপ্রভু নিজে শুধু নাচতেন না, সকলকেই নাচাতেন। এমনকী যখন বেড়াকীর্তন বা রথাগ্রে কীর্তনের জন্য তিনি সাত সম্প্রদায় ঠিক করে দিচ্ছেন, তখনও প্রত্যেক দলে গায়ক, বাদক, দোহারের সঙ্গে অন্ততঃ একজন করে নর্তকও ঠিক করে দিচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, সমবেত উদ্দণ্ড নৃত্যে তো সকলেই যোগ দিচ্ছেন, তাহলে আলাদা করে নর্তক ঠিক করবার দরকার কী? মনে হয়, এই নর্তকের বিশেষ ভূমিকা ছিল কীর্তনের রস পরিপুষ্টির কারণেই। এই নর্তনের মধ্যে শুধু নৃত্ত বা শরীরচালনা নয়, অভিনয় অঙ্গের প্রয়োগ ছিল বলেই মনে হয়। যে পদ গাওয়া হচ্ছে তার রূপটিকে নর্তক ফুটিয়ে তুলবেন এটাই হয়তো কাম্য ছিল। আজকে নামকীর্তনের কথা ভাবুন, সেখানে হৃদয়ের আবেগে সকলেই নেচে উঠতে পারেন। সেখানে কোনো ব্যাকরণ নেই। এবার ভাবুন লীলাকীর্তনের কথা, মূল গায়েন বিশেষ দক্ষতা সহকারে যে পদ গাইছেন তার মর্ম ফুটিয়ে তুলছেন। সেই ফুটিয়ে তোলা কখনো শুধুই বিভঙ্গ, কখনো আবার রীতিমতো চরিত্রাভিনয়। নৃত্যের এই দুটি রূপই তাহলে আমরা বীজ আকারে মহাপ্রভুর সময়ের কীর্তনে পেয়ে যাচ্ছি।
এতক্ষণ ধরে কীর্তনে নৃত্যের আবশ্যকতা নিয়ে বলার কারণ হলো, এ থেকে গানের ধরন নিয়ে কিছু অনুমান সঙ্গতভাবেই করা চলে। যে-গানে নাচ হবে, সে-গানকে অবশ্যই কাব্য-আশ্রিত হতে হবে। শুধুমাত্র সুর-তাল সহযোগে যে সঙ্গীত তাতে অভিনয়-যুক্ত নৃত্য করা চলে না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, মহাপ্রভু ও তাঁর পরিকরদের কীর্তন মূলত পদাশ্রয়ী। পদাশ্রয়ী কীর্তনে বেশি হুল্লোড় করা যায় না। কারণ গানের কথাকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। অতএব যন্ত্রানুষঙ্গকে হতে হবে নিয়ন্ত্রিত এবং পরিমিত। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, এই ধরনের কীর্তনে গায়ক ও বাদককে সুদক্ষ হতে হয়। যেহেতু মাধ্যমটি গেয়-অভিনেয়, অতএব অনেকের সমবেত প্রচেষ্টা এতে যুক্ত হয়। ফলত প্রশিক্ষিত গায়ক-বাদক না হলে একে অপরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যায় না। ইমপ্রোভাইজেশনের সুযোগ অবশ্যই আছে, কিন্তু অপটুতা বা অদক্ষতার কোনো জায়গা নেই। মহাপ্রভু এবং তাঁর পরিকরদের মধ্যে সেজন্য এত সংখ্যায় সুদক্ষ গায়ক-বাদক-নর্তক ও কবিকে আমরা দেখতে পাই। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, মহাপ্রভুর কীর্তন-পদ্ধতিতে অনেকগুলি অঙ্গ একসঙ্গে মিলেছিল – গান, বাজনা, নাচ, অভিনয় ইত্যাদি।
খেয়াল করে দেখুন, মাধবেন্দ্র বিষয়ক যে-সব বর্ণনা পাই, মিলিয়ে পড়লে তার মধ্যে থেকে গান-নাচ মেশানো একটা আদল তৈরি হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি যে, মাধবেন্দ্র পুরীর নৃত্য-গীত মহাপ্রভুর পূর্বসূরী। আমাদের বক্তব্য হলো, মাধবেন্দ্রের কীর্তনও ছিল পদাশ্রয়ী, ভাব-ব্যঞ্জক কীর্তন।
এই বক্তব্যের আর একটি ট্যানজেনশিয়াল প্রমাণও আমরা দিতে পারি। শুধুই তো নাচগান করতেন না এই সন্ন্যাসী, তিনি ছিলেন খুবই উচ্চস্তরের একজন কবি। রূপ গোস্বামী সংকলিত পদ্যাবলী তার সাক্ষ্য বহন করছে; এই কাব্যসংকলনে মাধবেন্দ্র পুরী রচিত বেশ কয়েকটি শ্লোক রয়েছে। এর মধ্যে অয়ি দীনদয়ার্দ্র নাথ শ্লোকটি বিপ্রলম্ভের শ্রেষ্ঠ পদ হিসেবে পরিচিত। মহাপ্রভু স্বয়ং এই শ্লোকটি পড়ছেন আর বলছেন যে –
রত্নগণ মধ্যে যৈছে কৌস্তভমণি।
রসকাব্য মধ্যে তৈছে এই শ্লোক গণি।।
নিত্যানন্দকে মাধবেন্দ্র পুরীর অসাধারণ ভক্তির কথা বলছেন মহাপ্রভু। বলে শেষ করতে পারছেন না। একবার উঠে হুঙ্কার করছেন আবার পরক্ষণেই কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ছেন। মুখে শুধু অয়ি দীন অয়ি দীন এই কথা। কৃষ্ণদাস কবিরাজ মন্তব্য করছেন যে, এই শ্লোক স্বয়ং রাধারানির বাণী, মাধবেন্দ্রের কাছে তার স্ফূরণ হয়েছে, আর একমাত্র গৌরচন্দ্র এই শ্লোক বুঝতে পেরেছেন। পৃথিবীতে চতুর্থ কোনো ব্যক্তি নেই যিনি এই শ্লোক আস্বাদ করবার ক্ষমতা ধরেন। অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় অনেক টীকা-টীপ্পনি রচিত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত এই শ্লোকটি লীলাকীর্তনের আসরে গাওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া কীর্তনে আরো গাওয়া হয়ে থাকে মাধবেন্দ্রের ভণিতা যুক্ত একটি বাংলা পদ – সাজল ধনি চন্দ্রবদনী শ্যাম দরশ আশে। মাধবেন্দ্রের বহুবিধ নৃত্যগীতের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর এই সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার কাব্যকৃতিকে পাঠ করলে আমাদের মনে হয় কীর্তনের এই প্রাগৈতিহাসিক ছবিটিই ফুটে ওঠে। একজন কবি যখন তাঁর প্রিয় দেবতার উদ্দেশ্যে গাইছেন বা নাচছেন, তিনি তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে নিশ্চয় কবিতার আশ্রয় নেবেন। মাধবেন্দ্র কী পদ গাইতেন তাঁর প্রিয় গোপাল বিগ্রহের সামনে? রেমুণায় এসে গোপীনাথের সামনেই বা কী গান গেয়ে নৃত্য করেছিলেন? নীলাচলে জগন্নাথদেবের সামনে কোন পদ পরিবেশন করেছিলেন? এইসব প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর যদিও নেই, তবু অনুমান করা যায়, তাঁর মতো প্রথম শ্রেণির কবি নিশ্চয় গেয়ে উঠেছিলেন রসোচিত কোনো গান – হয়তো সে গান নিজের লেখা, হয়তো আর কোনো পূর্বাচার্যের রচনা! কিন্তু মোটের ওপর একথা ঠিক যে, কীর্তন তাঁর সাধনের নিশ্চিত অঙ্গ ছিল। বস্তুত চৈতন্যদেবকে যে প্রেমভক্তি দিয়ে আমরা চিনি, সেই প্রেমভক্তি আসলে মাধবেন্দ্রের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।
সেইজন্যেই দেখি, যখন মাধবেন্দ্রের শেষ সময় উপস্থিত, তিনি কৃষ্ণ না পাইলুঁ বলে অহোরাত্র কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন। এমন সময় রামচন্দ্র পুরী নামে তাঁরই এক শিষ্য এসে তাঁকে উপদেশ দিতে আরম্ভ করলেন। রামচন্দ্র বললেন যে, সন্ন্যাসী ব্রহ্মচিন্তা করবেন, মোক্ষের কথা ভাববেন, তা না করে এই কান্নাকাটি করা কেন! শুনে সেই অসুস্থ অবস্থাতেও মাধবেন্দ্র খুবই রেগে গেলেন। শিষ্য গুরুকে উপদেশ করছে, সেটা তো অসঙ্গত বটেই, তবে মাধবেন্দ্র কিন্তু শুধু সেই কারণেই ক্রুদ্ধ হন নি। তিনি বলছেন যে, একে আমি কৃষ্ণ পেলাম না বলে নিজের দুঃখে মরছি, তার ওপর তুই আবার আমায় ব্রহ্ম-উপদেশ দিয়ে জ্বালাতে এলি কেন? তোকে দেখে মরলে আমার গতি হবে না, দূর হয়ে যা বাপু! রামচন্দ্র এই কারণে বিশ্ব-নিন্দুক হয়ে বেঁচে ছিলেন, পরবর্তীকালে স্বয়ং মহাপ্রভুকেও তাঁর নিন্দার পাত্র হতে হয়েছে। এর ঠিক উল্টোদিকে উদাহরণ পাচ্ছি ঈশ্বর পুরীর, তিনিও মাধবেন্দ্রের শিষ্য, কিন্তু মরমী শিষ্য। নিজে হাতে গুরুর মলমূত্র পরিষ্কার করছেন, সেবা শুশ্রুষা করছেন। কিন্তু তাঁর যে-সেবাটি গুরুকে সবচেয়ে আনন্দ দিচ্ছে সেটি হলো নিরন্তর তিনি কৃষ্ণকথা কৃষ্ণনাম শুনিয়ে যাচ্ছেন। এইখানে বলে রাখা যাক, ঈশ্বর পুরী নিজেও সুন্দর শ্লোক রচনা করতেন। ধরে নেওয়া যায়, গুরুদেবের রসপুষ্টি হয় এমন সব পংক্তিই শোনাচ্ছিলেন তিনি। মাধবেন্দ্র তখন তো বিপ্রলম্ভে আছেন, অয়ি দীন শ্লোকটি বলতে বলতেই তাঁর প্রয়াণ হয় একথা আমরা জানি। ঈশ্বর পুরী হয়তো সেই দশার কিছু শোনাচ্ছিলেন তাঁকে। যাই হোক, মাধবেন্দ্র এত প্রসন্ন হয়েছিলেন প্রিয় শিষ্যের মুখে কৃষ্ণকথা শুনে যে, তিনি ঈশ্বর পুরীকে আলিঙ্গন করলেন এবং আশীর্বাদ করলেন – কৃষ্ণে তোর হউক প্রেমধন। মনে করা হয়, গুরুর থেকে পাওয়া এই প্রেমের ভাণ্ডারটি উপযুক্ত সময়ে ঈশ্বর পুরী চৈতন্যদেবকে সঁপে দিয়েছিলেন। আমরা প্রেমধন বলতে ভাবাবস্থা তো বুঝবই, বোঝা যাচ্ছে যে মাধবেন্দ্র থেকে ঈশ্বর পুরী হয়ে একরকমের আধ্যাত্মিক-দার্শনিক ভাবসম্পদ মহাপ্রভু অবধি এসে পৌঁছল। কিন্তু ভাবদশার সঙ্গে সেই ভাবের অনুভাবটিও বুঝব। নাচ-গান-কবিতার একটি স্পষ্ট প্রকাশ আমরা মহাপ্রভু থেকে পেছোতে পেছোতে মাধবেন্দ্র অবধি দেখতে পাচ্ছি। এই ঐতিহ্যটি মাধবেন্দ্র কোথা থেকে পেয়েছিলেন? কেউ বলেন এ তাঁর নিজস্ব সাধনা, কেউ বলেন দক্ষিণ ভারতের আড়বার বা আলবারদের উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছেন। সেই প্রশ্ন এক স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি করে। আপাতত এইটুকু বুঝে নেওয়া গেল যে, মহাপ্রভুকে যে-কীর্তনের পিতা হিসেবে আমরা জানি, সেই গীত-বাদ্য-নৃত্য সমন্বিত ধারাটিতে মাধবেন্দ্র পুরীর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। প্রামাণিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে যে, মাধবেন্দ্র পুরী এই কীর্তন ধারার সূচনা বিন্দু যদি নাও বা হন, এই কীর্তনের অন্যতম প্রস্থান-বিন্দু হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।