সেবারও জগন্নাথের রথোৎসব চলছে। গৌড়দেশ থেকে অগণিত ভক্ত এসেছেন সচল মহাপ্রভুর সঙ্গে অচল জগন্নাথ মহাপ্রভুর দর্শন করবেন বলে। ততদিনে রূপ-সনাতন রাজকার্য ছেড়ে চলে এসেছেন মহাপ্রভুর কাছে – তাঁরা বৃন্দাবন চলে যাবেন কিছু দিন পরে। চলে এসেছেন যবন হরিদাস, নবদ্বীপ ছেড়ে। এখন তিনি পাকাপাকি নীলাচলবাসী। যাইহোক, উড়িয়া, গৌড়িয়া প্রভুর যত ভক্ত আজ নেমে এসেছেন রথের সামনে। প্রভু জগন্নাথ রথোপরি স্থাপিত হয়েছেন, সমস্ত জনারণ্যের মাঝখানে শুধু জয়কার-ধ্বনি শোনা যাচ্ছে—জয় জগন্নাথ! জয় মহাপ্রভু নীলাচল নাথ !
আমি এক কথায় দুই কথা বলব। এককথা হল – মহাপ্রভু জননী শচীদেবীর উপরোধে নীলাচলক্ষেত্রে রয়ে গেলেন, পরে তিনি বৃন্দাবনে গেছেন বটে, কিন্তু স্থায়ী আবাস শ্রীক্ষেত্র। দ্বিতীয় কথা হল – পুরীতে থাকার ফলে তাঁর মধ্যে সেই চিরন্তন বিরহ-দশা রয়েই গেল । ভাবটা এই – জগন্নাথের মধ্যে সেই শ্যামল-সুন্দরকে পেলাম বটে, কিন্তু বৃন্দাবনের মধুর রমণ-বসতিতে তাঁকে পেলাম না।
যাইহোক, রথাগ্রে উড়িয়া-গৌড়িয়াদের সংকীর্তন চলছে। হঠাৎই চৈতন্যদেব একটি সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করলেন সকলের সামনে। বলে নেওয়া ভালো—মধুর যে ছন্দোময়ী বাণী মহাপ্রভুর মুখ থেকে নির্গত হল, তার ভাব-রস সবটাই একেবারে প্রাকৃত সাধারণ নায়ক-নায়িকার প্রেমের বিষয়। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের বিশিষ্ট ভাবুকেরা এই শ্লোক বারংবার উদাহরণ দিয়েছেন ব্যঞ্জনা-বৃত্তির সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখানোর জন্য। সকলেই অবাক হয়ে গলে – মহাপ্রভু কৃষ্ণের কীর্তন অথবা তাঁর লীলাবিষয়ক মধুরালাপ বাদ দিয়ে কেন জগন্নাথের সামনে এমন এক জর্জর প্রাকৃত শ্লোক উচ্চারণ করলেন। এত কথার পর সেই শ্লোকের অর্থ না বললেই নয় এবং আরও বলা দরকার যে, এই শ্লোক লিখেছেন সংস্কৃতের এক বিখ্যাত মহিলা কবি।
প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমিকের দেখা হয়েছে বহুকাল পরে, কিন্তু যেখানে দেখা হয়েছে, সে জায়গাটা প্রেমিকার ভালো লাগছে না – এমন একটা জায়গা যেখানে প্রেমের সার্থক উদ্দীপন ঘটে না। প্রেমিকা বলছে –সেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হল। আমার প্রথম যৌবনে যিনি আমার কুমারীত্ব হরণ করেছিলেন, যিনি আমাকে অশেষে-বিশেষে কামনা করেছেন, আমার সেই কুমারীত্ব-হরণ-করা বর আমার সামনেই উপস্থিত। আছে সেই চৈত্রের রজনীও—বসন্ত রজনীর কোকিলালাপ-বাচাল যত উপকরণ, তাও ঠিকই আছে, সেই উন্মীলিত মালতীফুলের হাওয়া ভেসে আসছে প্রৌঢ়পুষ্প কদম্বের রেণু গায়ে মেখে। এমনকী আমিও তো সেই আমিই আছি। কিন্তু এ কেমন বুকের মধ্যে উথালি-পাথালি লাগে আমার—সেই যে সেই রেবা নদীর তীরে বেতসী-লতার কুঞ্জবনে তাঁর সঙ্গে যে আমার দেখা হত, প্রেমের সেইসব প্রথম আকুলতার অভিসন্ধিগুলি আমার সেই লজ্জা-কুঞ্জে ফেলে এসেছি, সেই রেবার তীরে বেতস-গৃহখানির জন্য আমার মন কেমন করে। ইচ্ছে করে সেইখানে ফিরে যাই আবার।
জগন্নাথের রথের সামনে সমস্ত ভক্তদের মধ্যে যখন এক দৈবভাব উদ্দীপিত হচ্ছে, সেই সময়ে এমন এক প্রাকৃত নায়িকার প্রেমাকুল বর্ণনা সবাইকে অবাক করে দিল। একবার নয়, দুবার নয়—এই শ্লোক মহাপ্রভু পড়েন বার বার। কেউ যার অর্থ বুঝল না, অন্তত চৈতন্যদেব কেন এই সময়ে এমন শ্লোক পড়লেন, তার অন্তর্গূঢ় রহস্যটা একজনই মাত্র বুঝতে পারলেন। তিনি হলেন পুরীতে মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ সঙ্গী স্বরূপ-দামোদর। মহাপ্রভুর অন্তরের এই আর্তি কেন, সেটা স্বরূপ বুঝলেন বটে, কিন্তু কাউকে বললেন না। হুসেন শাহের মন্ত্রী দবির খাস রূপও কিন্তু সেবার পুরীতে এসেছিলেন মহাপ্রভুর কাছে। সেই রথযাত্রায় তিনিও ছিলেন প্রভুর কাছাকাছি। তিনিও শ্লোক শুনে স্বস্থানে ফিরে গেছেন।
রূপ, সনাতন আর যবন হরিদাস – এই তিনজন জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতেন না। বহুকাল মুসলমান সুলতানদের রাজকর্ম করেছেন সেইজন্য রূপ-সনাতন নিজেদের বড় হীন এবং ম্লেচ্ছ বলে ভাবতেন, আর হরিদাসের দীনতা ছিল প্রশ্নাতীত। এরা জগন্নাথের মন্দিরে প্রবেশ করতেন না বলে মহাপ্রভু নিজেই এই তিনজনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন প্রতিদিন। সেই রথযাত্রার পরের দিন জগন্নাথের প্রাতঃকালীন উপল-ভোগ দর্শন করে মহাপ্রভু এসেছেন ওই তিনজনের সঙ্গে দেখা করতে। এসে দেখলেন — রূপ গেছেন সমুদ্র-স্নান করতে। হঠাৎই ওপর দিকে নজর পড়তে শ্রীরূপের ঘরের চালের ওপর তালাপাতায় লেখা একটি সংস্কৃত শ্লোক দেখতে পেলেন মহাপ্রভু। সে-যুগে বহু করে লেখার কালি তৈরি করতে হত এবং তালাপাতায় লেখার পর তা শুকোতে দিতে হত। তা ঘরের চালে শ্লোক শুকোতে দিয়ে রূপ স্নানে গেছেন আর তখনই মহাপ্রভুর নজরে এল রূপের অপূর্ব হস্তাক্ষর—শ্রীরূপের অক্ষর যেন মুকুতার পাতি।
রূপের লেখা শ্লোক পড়ে মহাপ্রভু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর অন্তরের মধ্যে সেই কৃষ্ণপ্রেমের আকুল ভাব জাগল, তিনি আবিষ্ট হয়ে রইলেন। স্নানশেষে রূপ ফিরে এসেই দণ্ডবৎ প্রণাম করে লুটিয়ে পড়লেন মহাপ্রভুর গায়ে। প্রভু তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন—কেউ যে-কথা বুঝতে পারল না – মোর মনের কথা তুই জানিলি কেমনে ? আনন্দে মহাপ্রভু সই শ্লোক-পাতি নিয়ে চললেন স্বরূপ–দামোদরকে দেখানোর জন্য। রূপ যে শ্লোক লিখেছেন সেটাও এক রমণীর বয়ান, কিন্তু সেটা প্রেমময়ী রাধার কথা, কৃষ্ণের উদ্দেশে। পুরাণে প্রমাণ আছে – রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের একবার দেখা হয়েছিল কুরুক্ষেত্রে। কুরুক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র বটে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রও বটে। যুদ্ধ লাগলেই দুই বিবাদী ক্ষত্রিয়া শিবির এখানে উপস্থিত হতেন ভালো করে যুদ্ধ করার জন্য। বিখ্যাত পানিপথ-যেখানে অন্তত তিন-তিনটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ হযেছে – সেই পানিপথও কিন্তু কুরুক্ষেত্রের পরিসরের মধ্যেই। তার মানে কুরুক্ষেত্র মানেই যুদ্ধ, কুরুক্ষেত্র মানেই যুযুৎসু ক্ষত্রিয়ের আনাগোনা। আর এই রকম একটা বিপরীত জায়গায় রাধার সঙ্গে দেখা হয়েছে কৃষ্ণের । রূপ গোস্বামীর সংস্কৃত অনুবাদে ব্যাপারটা রাধার আকুলতা ধরা পড়েছে । তিনি সহচরী সখাদের বলছেন —
সেই প্রিয়তম কৃষ্ণের সঙ্গেই আমার দেখা হয়েছে, আমিও সেই আমিই আছি। এমনকী আমাদের মধ্যে যে সেই মধুর মিলন তাও ঘটেছে, এই কুরুক্ষেত্রে। কিন্তু তবু, তবু সেই যমুনা-পুলিন-বনে মধুর মুরলীর পঞ্চম তান যা আমার মনের মধ্যে হু-হু করে উঠত, সেই যমুনা-পুলিনে যদি কৃষ্ণের সঙ্গে মিলন হত আমার, তাঁর জন্যে অন্তরে আমার দুঃখ রয়ে গেল।
ধরে নেওয়া যাক, রূপকৃত এই শ্লোকটি পুরাতন এক প্রাকৃত শ্লোকের কৃষ্ণঘটিত অনুবাদ। কিন্তু এখানে যেটা বড় হয়ে উঠেছে, সেটা হল হৃদয় বোঝার ব্যাপার। মহাপ্রভুর কৃষ্ণপ্রেমে, হৃদয়ের মধ্যেও সেই চিরবিরহকাতর রাধাভাব। অথচ মায়ের ইচ্ছায় মূল্য দিতে গিয়ে সন্ন্যাসীর স্বাধীনতা গ্রহণ করে তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে থাকতে পারলেন না। নীলাচলক্ষেত্রে জগন্নাথদেবের মধ্যেও তিনি তাঁর শ্যামল-কিশোরকে দেখতে পান বটে, কিন্তু তাত্ত্বিকতার দিক থেকে সেই দর্শনে ভেদ না থাকলেও কৃষ্ণের স্ব-পদ-রমণ বৃন্দাবনের মধ্যেই রাধা যেমন তাঁকে পেতে চান মহাপ্রভুর ভাবও তেমনই।
অর্থাৎ সেই যমুনার তীর, সেই বৃন্দাবন। চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর প্রিয় পার্ষদ রূপের সেই শ্লোক ভুলতে পারছেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই শ্লোকের রূপ দিলেন কীর্তনের ভাষায়, কীর্তনের অঙ্গে, কীর্তনের ছন্দে। কাজটা ঠিক কে করলেন জানা নেই, কিন্তু সরল বাংলা ভাষায় একটা কীর্তনের কলি তৈরী হল এবং চরিতামৃতকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন –
জগন্নাথ দেখি প্রভুর সে ভাব উঠিল।
সেই ভাবাবিষ্ট হইয়া ধুয়া গাওয়াইল।।
‘ধুয়া’ (বাংলায় ধুয়া কথাটা ধ্রুবা থেকে এসেছে। সাধু ভাষায় এটি ধ্রুবপদ, ধ্রুবক অথবা ধ্রুপদ।) মানে গানের সেই পদ-পদাংশ যেটা গানের প্রথমে গাওয়া হয় এবং কীর্তনের দোহাররা যেটা গেয়ে সুর রক্ষা করেন। চরিতামৃতকার মহাপ্রভুর অন্তর-ভাণ্ডারী স্বরূপের মুখে এবার যে ধুয়া গাওয়ালেন, সেটা কিন্তু একটা ভাবান্তরের পর। প্রথম জগন্নাথকে রথে আসতে দেখে রাধাভাবিত মহাপ্রভু এতটা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি গানের ধুয়া গাইলেন –
সেই তে পরাননাথ পাইলুঁ
যাহা লাগি মদন-দহনে ঝুরি গেলু।
এই ধুয়া দামোদর পণ্ডিত গাইতে লাগলেন উচ্চৈঃস্বরে, আর চৈতন্য মহাপ্রভু সেই ধুয়ার সুরে নাচতে লাগলেন আনন্দে। কিন্তু ক্ষণিকেই তাঁর ভাবান্তর ঘটে গেল। জগন্নাথের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে পড়তেই জগন্নাথের রথ, লোকারণ্য সব তাঁকে অন্যভাবে আনমনা করে খুলল, তাঁর ভাবান্তর হল। তারপর সেই বিখ্যাত রসশ্লোক ‘যঃ কৌমারহরঃ’ এবং অবশেষে তাঁর ভাবান্তরের গান। পুরীতে জগন্নাথের যখনই দেখেন, প্রভু ভাবেন যেন কুরুক্ষেত্র দেখা হয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে। কবিরাজ কৃষ্ণদাসের অনবদ্য পয়ারে ভাবটা এইরকম দাঁড়ায় –
সেই তুমি সেই আমি সে নব সঙ্গম।।
তথাপি আমার মন হরে বৃন্দাবন।
ইঁহা লোকারণ্য হাতী-ঘোড়া-রথধ্বনি।
তাঁহা পুষ্পবন-ভৃঙ্গ পিক-নাদ শুনি।।
ইঁহা রাজবেশ সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের গণ।
তাঁহা গোপগণ সঙ্গে মুরলীবদন।।
ব্রজে তোমার সঙ্গে যেই সুখ-আস্বাদন।
সে সুখ-সমুদ্রের ইঁহা নাহি এক কণ।।
আসা লৈয়া পুন লীলা কর বৃন্দাবনে।
তবে আমার মনোবাঞ্ছা হয় তো পূরণে।।
এই কীর্তন বিখ্যাত করে দিয়েছেন রামদাস বাবাজিমশায়। আসলে রথের ওপর জগন্নাথকে দেখে রাধা-ভাবে ভাবিত চৈতন্য মহাপ্রভু অন্তরে যে প্রথম মিলনের ভাবটুকু ভাষায় প্রকট হয়ে উঠল, সেই প্রকটিত ভাবটাই কিন্তু সুর, তাল, লয়্রে শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে এমন একটা সঙ্গীত-প্রকৃতি তৈরী করছে, যাকে আমরা কীর্তন বলছি। প্রথম ভাবে যে মিলনের ভাষা, সুর, তাল এমনকী ভাবও – সেই তো পরাণ-নাথ পাইনু বলে মহাপ্রভু ধুয়া ধরলেন – হয়তো এইটুকুই তখন কীর্তনাঙ্গ ছিল, ছিল পুরাতন রাগ-রাগিনী – স্বরূপ-দামোদর তাতেই ধ্রুপদ গাইলেন –
সেই কো পরাণ-নাথ পাইলুঁ
তার সঙ্গে বড়ো জোর আর এক পংক্তি –
যাহা লাগি মদন-দহনে ঝুরি গেলুঁ
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এবং অনেক গবেষণার পরেই এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে, এই ধ্রুবপদটুকু চৈতন্য মহাপ্রভুরই ভাবোচ্ছ্বাসে সৃষ্ট। চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির পদাবলী তিনি বারবার আস্বাদন করেছেন—কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত পদটুকু তাঁদের রচনা নয়। অথচ তাঁদের ভাষা আক্রান্ত স্বরূপ-দামোদর অথবা মহাপ্রভুর ভাষা এবং ভাবকে। সেটাই স্বাভাবিক। কেননা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা বদলেছে, সহজ হয়েছে। বিশেষত কীর্তনের সে সুর প্রধানত রাগরাগিনীর আশ্রয়ে ছিল তা তো কালের গতিতে পালটাবেই, তাই পালটেওছে। বাংলার জয়দেব কবি – যিনি সংস্কৃত কাব্যকর্তাদের শেষ বংশধর অথচ বাংলা কাব্যভাষার সাংস্কৃতিক এবং সাংস্কারিক জনক – তিনি যে ‘ধীর-সমীরে যমুনা-তীরে’র গান গেয়েছিলেন, অথবা তাঁর ‘ললিত-লবঙ্গ-লতা’ যেভাবে প্রাবাদিক গানের কলি তৈরী করে দিয়েছিল, তার সুর-স্বর, রাগ-রাগিনী চৈতন্য মহাপ্রভুর কাল ব্যাপ্ত করে দিয়েছিল নিশ্চয়ই, নাহলে মৈথিল বিদ্যাপতির প্রায়-প্রভাবিত- ‘সেই তো পরাননাথ পাইনু’ কিংবা রায় রামানন্দের ‘আপন কৃত গীত’ ‘পহিলহি রাগ নয়নভঙ্গ ভেল’ – এসব গান কিন্তু কীর্তনাঙ্গে চৈতন্য মহাপ্রভুর কানে পৌঁছেছে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হল – কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক সম্ভোগ-বিরহকল্পের মাধুরী-মাখা এই যে সব কীর্তন, তার প্রকট স্থান কিন্তু নীলাচলক্ষেত্র অর্থাৎ পুরী। এখানে রায় রামানন্দের মতো দক্ষিণী রসিক নিজে কীর্তনের পদ লিখছেন, স্বরূপ-দামোদরের মতো পণ্ডিত-রসিক মহাপ্রভুর নির্জন সহচর, আর ওদিকে আছেন দামোদর পণ্ডিত এবং বাসুদেব ঘোষের মতো গাইয়ে। সব মিলিয়ে নীলাচলে যে কীর্তন চলত – তার পদ, তার সুর-স্বরের ঠাটবাট এতটুকুও নবদ্বীপে মহাপ্রভুর পুরাতন নাম সংকীর্তনের মতো নয়। অথচ এই কীর্তন চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুপ্রেরণায় তৈরী – তার প্রমাণ আছে।
সেবারও গৌড়িয়া ভক্তবৃন্দ নীলাচলে এসেছেন রথযাত্রার কালে। কিন্তু পুরীতে চৈতন্য মহাপ্রভু বেশ কিছু কাল থাকা সত্ত্বেও উড়িষ্যার রাজা গজপতি প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়নি তখনও। চৈতন্য মহাপ্রভুই রাজার মতো ঐশ্বর্যশালীর সঙ্গে পরিচয়ে কানিক কুণ্ঠিত ছিলেন। চৈতন্য পার্ষদেরা – সার্বভৌম ভট্টাচার্য, রামানন্দ রায়েরা অবশ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ওই পরিচয়ের। রথযাত্রা এগিয়ে আসছে, গৌড়ের ভক্তেরা নানা জায়গায় কীর্তন করে যাচ্ছেন সম্মিলিত হয়ে। এর মধ্যে রাজ-প্রাসাদের উপরিতলে দাঁড়িয়ে সার্বভৌম ভট্টাচার্য গৌড়িয়া ভক্তদের চিনিয়ে দিচ্ছিলেন একে একে, কিন্তু সেই চেনার সঙ্গে সঙ্গে কীর্তনের সুর ভেসে আসছিল প্রতাপরুদ্রের কানে। অপূর্ব-শ্রুত এই কীর্তনের ধ্বনি শুনে –
রাজা কহে – দেখি মোর হৈল চমৎকার।
বৈষ্ণবের ঐছে ভেজ দেখি নাহি আর।।
কোটি সূর্য সম সব – উজ্জ্বল বরণ।
…,স কভু নাহি দেখি এই মধুর কীর্তন।।
ঐছে প্রেমে ঐছে নৃত্য ঐছে হরিধ্বনি।
কাঁহা নাহি দেখি ঐছে কাঁহা নাহি শুনি।।
গজপতি প্রতাপরুদ্র উড়িষ্যার রাজা, জগন্নাথের পূজারি। কাজেই মন্দিরের ভজন-কীর্তন তিনিও শুনে থাকবেন কিছু, কিন্তু বাংলার কীর্তনাঙ্গ তাঁর জানা ছিল না তেমন করে, তাঁর কাছে গৌড়িয়াদের কীর্তনধ্বনি তাই ‘চমৎকার’। প্রতাপরুদ্রের বিস্ময়-চমৎকার দেখে –
ভট্টাচার্য কহে এই মধুর বচন।
চৈতন্যের সৃষ্টি এই প্রেম-সঙ্কীর্তন।।
অর্থাৎ প্রতাপরুদ্র যে কীর্তন শুনেছেন, সেটা কিন্তু নাম-সংকীর্তন নয় , যেটা প্রেমসংকীতন — সার্বভৌম ভট্টাচার্য বলছেন – এটা চৈতন্যের সৃষ্টি । আমরা এটাই বলতে চাই – কীর্তন আগেও ছিল, কিন্তু যে কীর্তন স্বরে-সুরে –ভাবে মাতোয়ারা করে সেই বাংলার কীর্তন গজপতি শোনেননি এবং সেটা চৈতন্যেরই সৃষ্টি। এখানে মনে পড়া উচিত চৈতন্য ভাগবতের প্রমাণ। পিতৃশ্রাদ্ধ সেরে ঈশ্বরপুরীর মন্ত্র কানে নিয়ে চৈতন্য যখন গয়া থেকে নবদ্বীপে ফিরছেন, তখন তাঁর উন্মত্তের মতো – উন্মাত্তবৎ গায়তি নৃত্যতি ক্বচিৎ — তিনি হরিনামে মাতোয়ারা। তাঁর ব্যাকরণ পড়ানোর টোলে পড়াশুনো ছেড়ে তাঁর ছাত্র-শিষ্যেরা প্রভুর মত্ততা দেখছেন। অবশেষে একদিন বিদ্যায় ইতি দিয়ে চৈতন্য তাঁর শিষ্যদের বলেই ফেললেন – অনেক পড়াশুনো হয়েছে, এবার কীর্তন করো –
পড়িলাভঙ শুনিলাঙ যতদিন ধরি।
কৃষ্ণের কীর্তন কর পরিপূর্ণ করি।।
তখনও কিন্তু তাঁর টোলের ছাত্রেরা জানেন না যে, কীর্তন জিনিসটা কী, সেটা কী করে করতে হয়। চৈতন্য এবার শেখাতে আরম্ভ করলেন কেমন করে কীর্তন করতে হয় – তার সুর, স্বর, রাগিনী এবং সেই জনপ্রিয়তম কীর্তনের পদটির এখনও চলে এবং সেই কীর্তনে পংক্তি যুক্ত হয়েছে আরও অনেকগুলি। চৈতন্য ভাগবতের বয়ানে — আকর কীর্তনটি এই রকম –
শিষ্যগণ বলেন – কেমন সংকীর্তন।
আপনে শিখায়েন প্রভু শ্রীশচীনন্দন।।
(হরে) হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ।
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন।।
দিশা দেখাইয়া প্রভু হাতে তালি দিয়া।
আপনে কীর্তন করে শিষ্যগণ লৈয়া।।
আপনে কীতর্ন-নাথ করেন কীর্তন।
চৌদিকে বেড়িয়া গায় সব শিষ্যগণ।।
শিষ্যদের তালিম দেবার জন্য যে গানটি চৈতন্য মহাপ্রভুর মুখে উচ্চারিত হয়েছিল – প্রথমত, সেই গানটি এখনও গাওয়া হয়, যদিও চৈতন্য ভাগবতে এই গানের জন্য যে ‘কেদার রাগ’ নির্দিষ্ট আছে, তার অবশিষ্ট এখনকার গানে অনুসৃত হয় কিনা, সেটা বলা কঠিন। এই গানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল সংস্কৃত ভাষা এবং বাংলা ভাষার মিশ্রন। প্রথম পংক্তিটি সংস্কৃত, যায় দ্বিতীয় পংক্তি এখনকার কীর্তনে উচ্চারণ করি আমরা –
(হরে) হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ যাদবায় নমঃ।
যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমঃ।।
চেতন্য ভাগবতে দ্বিতীয় চরণেই বাংলা ভাষা —
গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন।
তার দ্বিতীয় পংক্তিতে আমরা এখনও
গেয়ে থাকি —
গিরিধারী গোপীনাথ মদনমোহন।।
এই গান চৈতন্য মহাপ্রভুর আগে কোনো পদাবলীতে আমরা পেয়েছি বলে মনে করি না। গানটি তাঁর গুরু ঈশ্বরপুরীর মুখনিঃসৃত কোনো লোক প্রচলিত পদ কিনা, তাও বলা মুশকিল। কিন্তু চৈতন্যচরিতের দুটি উৎস – প্রথমত চৈতন্যভাগবতে নদীয়া বিহারী চৈতন্য শিষ্যদের কীর্তন কী করে করতে হয়, সেটা শেখাচ্ছেন। ফলে বৃন্দাবন দাস তাঁকে কীর্তন-নাথ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর দ্বিতীয় উৎস চৈতন্য চরিতামৃতে স্বয়ং সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মুখে শুনছি – চৈতন্য চরিতামৃতে স্বয়ং সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মুখে শুনছি –চৈতন্যের সৃষ্টি এই প্রেমসংকীর্তন।
আমরা এখানে বাংরার কীর্তনের ইতিহাস রচনা করতে বসেছি, সেখানে চৈতন্য মহাপ্রভুকেই আমরা বাংলার কীর্তনগানের স্রষ্টা মনে করি। তিনি সংকীর্তন-নাথ, সংকীর্তন-পিতা। এমনকী কীর্তনের যে প্রধান অনুষঙ্গ খোল-করতাল, তারও প্রবর্তক-সংস্কারও আমাদের চৈতন্য মহাপ্রভু — যেমনটি নরহরি চক্রবর্তী লিখেছেন ভক্তিরত্নাকরে —
শ্রীপ্রভুর সম্পত্তি শ্রীখোল-করতাল।
তাহে কেহ অর্পয়ে চন্দন পুষ্পমাল।।
নদীয়া-নগরীতে খোল-করতালের ধ্বনিতে নাম-সংকীর্তনের যে ধারা তৈরী হল, সেই সহজ লোকগ্রাহ্য কীর্তনই জগন্নাথক্ষেত্রে নবকালেবর ধারণ করেছিল চৈতন্যেরই প্রতিভায়। গম্ভীরায় ‘স্বরূপ-রামানন্দ সনে চৈতন্য মহাপ্রভুর যে আস্বাদ্য বস্তু ছিল, সেটা কিন্তু ‘চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি’ / রায়ের নাটকগীতি / কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ’। বলা বাহুল্য, রামানন্দ রায়ের নাটকে অনেক জায়গাতেই লঘু পদ্যগুলিতে যেমন গানের অবসর আছে, তেমনই গীতগোবিন্দ তো রাগাশ্রয়ী গানের জন্যই রচিত। লীলাগুরু বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃত- কর্ণরসায়ন গীতিশ্লোকই বটে। আর বাকী যাকে চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি –যেখানে কৃষ্ণলীলা-কীর্তনের অবধি তৈরী হয়েছে। বিদ্যাপতির গান চৈতন্য মহাপ্রভুর মুখে শোনার দৃষ্টান্ত, আমরা পাইনি বটে, কিন্তু একই ধাঁচায় ‘সেই তো পরাননাথ পাইনু’ অথবা রায় রামানন্দের কলি – ‘ন সো রমণ ন হাম রমণী’ – এগুলি তো বিদ্যাপতির সমান্তরাল।
কিন্তু পদাবলীর এই সব গান – যার পদ-বাক্য-ছন্দোবিন্যাস দেখে আমরা ধরেই নিতে পারি যে, বিচিত্র রাগ-রাগিনীর পরামর্শে এগুলি অতিসুমধুর হয়ে, থাকলেও এগুলি কোনো অনিবদ্ধ সঙ্গীত ছিল না। অর্থাৎ ধ্রুপদী সঙ্গীতে যে আলাপ বা আলপ্তির অংশ থাকে, পদাবলী-কীর্তন বা লীলাকীর্তন কখনোই আলাপমাত্রেই শেষ হয়ে যেত না, কারণ পদাবলীর পদই সেখানে প্রধান অন্তরায়। এখানে বলা দরকার চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে যে পদাবলী-কীর্তন শুরু হয়েছিল, তার সুর-স্বর যতই রাগাশ্রিত থাকুক বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের পদ অর্থযুক্ত কথার মধ্যে আবদ্ধ ছিল, তাই শুধুমাত্র ‘আলপ্তি’ ‘আলাপ’ বা ‘আলাপচারি’-তেই বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের পদ গাওয়া শেষ হত না। আমাদের ধারণা, রাগ-রাগিনী সঙ্গে বাংলার লোকগীতির কিছু সুরের ভাবনা অনুস্যূত হয়েই কীর্তনের এক নতুন genre তৈরী হয়, যেটাকে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে পারি – ‘চৈতন্যের সৃষ্টি এই প্রেম-সঙ্কীর্তন’।